PUBLISHED

3/20/2013

Rising and Falling of Buddhism in India







প্রাক্‌-কথন
ছোটকালে কলকাতা অবস্থানকালীন বিশ্ব-বিখ্যাত পণ্ডিত রা-হূল সাংকৃত্যায়নকে প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য লাভ করে থাকলেও  আজ তাকে যতখানি বুঝেছি,তখন ততখানি বুঝা সম্ভবপর হয়নি।তিনি ছিলেন তথাগত বুদ্ধের অনুসারী ভিক্ষু। তীক্ষ্ণ প্রতিভা-মণ্ডিত দেহকান্তী দেখে তাকে বুদ্ধের প্রকাশ বলেই আমার চোখে প্রতিভাত হয়েছিল।তাঁর চরিত্র-চিত্রণ প্রসঙ্গে যদি বলি তবে বলতে হয়,তিনি ছিলেন সতত প্রশান্ত,সৌম্য ও সুধীর।তাঁর দৃষ্টি ছিল বিশ্ব-জনীন। বিশ্বের মানব সমাজে তিনি এক চির ভাস্বর সন তারকা।বিশ্বের সমুন্নত দেশগুলোর মধ্যে খুব কম দেশই আছে, যে দেশে রাহূলজী জ্ঞান সন্ধানের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেননি। রাহূলজীর জীবনে ধর্ম নীতি,রাজনীতি ও সমাজ নীতির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি ধর্ম,সংস্কৃতি,গল্প,উপন্যাস,নাটক ইতিহাস,দর্শন,বিজ্ঞান,সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কিত ১৫০ টি গ্রন্থের প্রণেতা। তা ছাড়া বারবার তিব্বত গমন-পূর্বক তিব্বত থেকে ছোট বড় প্রায় সাড়ে তিন শত পথই সংগ্রহ করে এনেছেন। তন্মধ্যে এমন সব অমূল্য সম্পদ রয়েছে, যা তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ করার সুযোগ পাননি।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর প্রণীত বহু-গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে।তাঁর আবির্ভাব,সৃজন-সাফল্য ও আবিষ্কারকে বিশ্বের বিব্দজন সমাজ শতাব্দীর পর শতাব্দী অপার শ্রদ্ধা অ কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতে পারবেন
                আমি আগ্রহ করে রাহূলজীর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ আমাদের গ্রন্থাগারের জন্য সংগ্রহ করেছি। তন্মধ্যে ঝিনুকের মত চিকন মাত্র দশ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা –“ভারত মে বৌদ্ধ ধর্ম্‌কা উত্থান ঔর পতন”। ইহা হিন্দি ভাষায় লিখিত। এই পুস্তিকার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো-যে ধর্ম তৎকালীন বৃহত্তম ভারতের সমগ্র অঞ্চলে বিতৃত ছিল ,যে ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা আজও বিশ্বের মানব জাতির মধ্যে বৃহত্তম, এরূপ প্রভাব প্রতিপত্তিশালী যে বৌদ্ধ


ধর্ম আপন মাতৃভূমি ভারত-বর্ষে কেন এত সহসা বিলুপ্ত হয়ে গেল?-এটা আশ্চর্যজনক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে রাহূল সাংকৃত্যায়ন বৌদ্ধ-ধর্মের উত্থান-পতন সম্পর্কিত বিচার বিশ্লেষণ করেছেন।
          এই পুস্তিকার কতক শব্দ-সংযোজনা ও বিষয় বস্তুর অবতারণা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। আমি সেই বিতর্কের কিছুটা নিরসন করার চেষ্টা করব।রাহূলজী পুস্তিকার প্রথম পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন,-“এই ধর্মের ভাস্কর্য ও স্থাপত্য বিদ্যায় পারদর্শীগণ হাজার হাজার বর্ষ-ব্যাপী সজীব পর্বত-বক্ষকে মোমের মত কর্তন করে অজান্তা,ইলোরা,কার্লে ও নাসিক প্রভৃতি গুহা মন্দিরগুলো যেই আশ্চর্য-ভাবে প্রস্তুত করেছেন,তার গম্ভীর তাৎপর্য অবগত হওয়ার জন্য যবন ও চীনাদের মত সমুন্নত জাতি আগ্রহান্বিত হয়েছিলেনতৃতীয় পৃষ্ঠায়-মৌর্য সম্রাজ্য বিনষ্ট হওয়ার পর যবন রাজ মিনান্দার পশ্চিম ভারত অধিকার করেছিলেন।যবন রাজারা অধিকাংশ বৌদ্ধ ছিলেনচতুর্থ পৃষ্ঠায়-যবনদিগকে পরাস্ত করে শকেরা পশ্চিম ভারত অধিকার করলেন।এক্ষেত্রে যবন শব্দটির সম্পর্কে কতক তত্ত্বমূলক আলোচনার প্রয়োজন।
          পালি ও সংস্কৃত ব্যাকরণের ধাতুর নিষ্পন্ন শব্দ যবতীতি যবন-অর্থাৎ আগমন-পূর্বক মিলিত হয় বলে যবন।
          মানব সভ্যতার বিচারে গ্রীক-জাতি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন সভ্য জাতি।যিশু খৃষ্টের জন্মের বহু কাল পূর্বেই গ্রীক জাতি সভ্যতার চরমে পৌঁছেছিলেন।বিশেষ করে স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বিদ্যায়।তাদের অপূর্ব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বিদ্যাই তাদের তীক্ষ্ণ ধী-শক্তি ও-শিল্প-চাতুর্যের নিদর্শন।গ্রীস দেশের অন্তর্গত একটি উপনিবেশের নাম আইয়োনিয়া (ionia)এর সংক্ষিপ্ত রূপ-আয়োনা। এই আয়োনা শব্দই ভারতীয়দের মখে হল ’, ‘য়োহল অন্তস্থ ’, এবং ঠিকই রইল।কালক্রমে আয়োনা শব্দের অপভ্রংশে যবন হয়ে গেল।এই আয়োনা উপনিবেশের অধিবাসী গ্রীক-দিগকে যবন জাতি,তাদের দেশকে যবন দেশ এবং তাদের

লিপিকে যবনানি বলা হত। এশিয়াটিক সোসাইটির সেক্রেটারি বিখ্যাত ইংরেজ পণ্ডিত উইলসন সাহেবের মতে বাহুলিক বা ব্যাকট্রিয়া থেকে আয়োনা  পর্যন্ত গ্রীস উপনিবেশের অধিবাসী গ্রীক-দিগকে ভারতীয়রা যবন ওতাদের লিপিকে যবনানি বলত।তথাগত বুদ্ধের বিশ্ব-প্রেমী ধর্ম বিদেশী হিসাবে এই যবন-দিগকেই সর্বপ্রথম আকৃষ্ট করেছিল।যবনেরা ভারতে এসে পুরুষানুক্রমে বসবাস করে ক্রমে ক্রমে  ভারতীয় ধর্ম,সংস্কৃতি,কৃষ্টি,ব্যবসায়,বাণিজ্য,রাজ্য প্রভৃতির সাথে আপন সত্তা সম্পূর্ণভাবে মিশিয়ে ফেলে ভারতবর্ষকে স্বদেশ রূপে মেনে নিয়েছিলেন।এর স্বপক্ষে বহু প্রমাণই রয়েছে।বৌদ্ধ-গ্রন্থে দেখা যায়,-খৃঃপূঃ তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোক ধর্ম প্রচারের জন্য দেশ-বিদেশ যে সব ভিক্ষুকে পাঠিয়েছিলেন,-তন্মধ্যে যবন মহারক্ষিত ও যবন ধর্মরক্ষিত যবন প্রদেশে বা যোনক ব্যাক্‌ট্রিয়া ও আয়োনায় গিয়েছিলেন।যবনেরা কোন সময় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন,তা সঠিক জানা না গেলেও সম্রাট অশোকের সময়ে তো বটেই-তার পূর্বেও যবনগণ-বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।যবন মহারক্ষিত ও যবন ধর্মরক্ষিত স্থবির যে যবন দেশ-জাত, তা সহজে অনুমেয় এবং তাঁরা যে সম্রাট অশোকের তা পূর্বেকার তাও নিশ্চিত।তাঁরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের পর বহু দিন ব্যাপী বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্রে জ্ঞান উপার্জন করেছিলেন যদ্বারা তাঁরা স্বদেশে বা অন্যদেশে ধর্ম প্রচারক  রূপে প্রেরিত হবার যোগ্য বিবেচিত হলেন।অশোকের জন্মের মাত্র ৬৩ বৎসর পূর্বে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ঘটনা ঘটে।তখনও অসংখ্য গ্রীকের আগমন হয়।তারাও ভারতীয়দের নিকট যবন নামে পরিচিত।ভারতীয় গুহা-মন্দিরগুলোর চিত্রের পাশে দাতার বা চিত্রকরের নাম খোদিত আছে।প্রত্যেক নামের পূর্বে যবন শব্দটি রয়েছে।নামগুলো ভারতীয় হলেও যবন দেশ-জাত লোক বলে প্রত্যেক নামের পূর্বে যবন শব্দ রয়েছে।নচেৎ ভারতীয়দের নামের পূর্বে যবন শব্দ থাকবে কেন? বস্ততঃ ভারতী বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যবন বৌদ্ধদের অবদান অতুলনীয়।বৌদ্ধ স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বিদ্যার সর্বপ্রথম প্রবর্তন যবন বৌদ্ধগণ দ্বারা।গান্ধার দেশে প্রাপ্ত প্রাচীনতম শিল্পগুলো গ্রীক ভাস্কর্যের সুন্দরতম নিদর্শন।ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে বৌদ্ধ শিল্পকলা
যে আজ বিশ্বের শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে-যবন বৌদ্ধদের অবদান অনস্বীকার্য।
          খৃঃপূঃ ১২৫অব্দে মিলিন্দ প্রশ্ন নামে একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ গ্রন্থ রচিত হয়।গ্রীস দেশীয় রাজা মিনান্দর ও মহাস্থবির নাগসেনের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের বিতর্কিত জটিল বিষয় নিয়ে প্রশ্নোত্তরসহকারে যে কথোপকথন হয়েছিল, তাই পরবর্তী কালে মিলিন্দ প্রশ্ন নামে অভিহিত গ্রন্থ।এই গ্রন্থের সর্ব প্রথমে সাকলা(বর্তমান শিয়ালকোট) নগরের বর্ণনায় যবন শব্দের উল্লেখ আছে।সাকলানগর যবনদের ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ও রাজা মিনান্দরের রাজধানী ছিল।তাঁর রাজত্বকাল খৃঃপূঃ১৪০-১১০ অব্দ।বৌদ্ধশাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, যে দিন যবন-রাজ মিনান্দরের সঙ্গে পাঁচশত যবন উপস্থিত ছিলেন।
          শকদের ভারতে আগমন কাল খৃঃপূঃ দ্বিতীয় শতক।শকদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ব্যাকট্রিক ও আয়োনা নিবাসী গ্রীক রাজারা পশ্চিম ভারতে বহু কাল রাজত্ব করেছিলেন।এই গ্রীক রাজারা সবাই বৌদ্ধ ছিলেন।এজন্য বাহুলজী বলেছেন-যবনরা অধিকাংশ বৌদ্ধ ছিলেন এবং যবনদিগকে পরাস্ত করে শকেরা পশ্চিম ভারত অধিকার করেছিলেন।পৌরাণিক পালি সংস্কৃত গ্রন্থে যবন শব্দের বহুল প্রয়োগ দৃষ্ট হয়।সেই প্রয়োগে কারো প্রতি হেয় জ্ঞান ছিল না,ছিল সম্মান সূচক ব্যবহার।রাহুলজীও যবন শব্দটি উন্নত জাতি ও দেশ-ভিত্তিক শব্দ-রূপেই ব্যবহার করেছেন।কোন জাতি বা ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য জ্ঞানে ব্যবহার করেন নি।পরবর্তী কালে যবন শব্দটি বিদেশী আক্রমণকারী ও অত্যাচারী দলের প্রতিও ব্যবহৃত হয়েছে।এমনকি, বহু শতাব্দী পর কোন বাংলা সাহিত্যের কাব্য ও উপন্যাস গ্রন্থে বিশ্বাস ঘাতকতার উপলক্ষে পশ্চিম দেশীয় মুসলমানকেও হেয়কালে যবন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।বাংলা বিশ্ব কোষ-অভিধানে যবন শব্দের অর্থ এরূপ বিভিন্ন রূপেই করা

হয়েছে।বর্ণ,গোত্র ও সম্প্রদায়-বহুল দেশে একে অন্যের প্রতি কত রকমের শব্দ যে হেয়-জ্ঞানে ব্যবহার করে থাকে,-তার ইয়ত্তা নেই।পণ্ডিতকে গালিচ্ছলে অজ্ঞ শব্দ ব্যবহার করলে কিংবা অজ্ঞকে ব্যঙ্গ করে পণ্ডিত বললে মনোক্ষুণ্ণতার সৃষ্টি করা যায় বটে, কিন্তু মৌলিক স্বাভাবিক শব্দের অর্থ বৈকল্য ঘটান যায় না।ইহাতে আপন কলুষিত মনোভাবেরই পরিচয় হয় এবং সাম্প্রদায়িক বুদ্ধির বিষ ছড়ানো হোয় মাত্র।বৌদ্ধ বিনয়-বিধানে আছে-কোন মানুষের প্রতি বর্ণ,গোত্র,সম্প্রদায় বা জাত ধরে সাধারণ কথা বলাও অপরাধ,যেহেতু এক্ষেত্রে মানবতা বিরোধী ভেদ-বুদ্ধির আভাস আছে।হেয়-জ্ঞানে যাদেরকে বলা হয়েছে-যবন,পরম যত্ন ও গৌরবের সাথে তাঁদের ধর্ম-শাস্ত্রের পঠন-পাঠন,লিখন ও ভাষান্তর কার্যে সারাটি জীবন অতিবাহিত করতেও দেখা গিয়েছে।যে শাস্ত্রে বুদ্ধকে চোর বলে কটূক্তি করা হয়েছে,সেই শাস্ত্রেই আবার বুদ্ধকে পরমাত্মার অবতার রূপে মেনে নিয়েছেন।জগতে এরূপ নিন্দা প্রশংসার দুই বিপরীতমুখী ভাব ভাষার অভাব নেই।আমাকে নিন্দা করে বলেই,আমি দুঃখিত হই।এই আমাকেই তো অনেকে প্রশংসা করে থাকে।আজ আমাকে প্রশংসা করল বলে আমি আনন্দে বিহ্বল হি কেন,এই আমাকেই আবার অনেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকে।এরূপ তুলা-দণ্ডে সাম্য সৌম্য ভাব রক্ষা করাই পুরুষত্ব।
          এই উপমহাদেশে একটি প্রবাদ আছে যে,বৈদিক জ্ঞান কাণ্ডের প্রবর্তক শঙ্ক্ররাচার্যই ভারইতে বৌদ্ধ ধর্মের পতনের কারণইহা শুধু জনশ্রুতি নহে,শাস্ত্রীয় প্রমাণও আছে।
                   আসেতোরা তুষারাদ্রে বৌদ্ধানা বৃদ্ধ বালকম্‌।
                   ন হস্তি যঃ স হন্তব্যো ভৃত্যানিত্যম্ব শান্নৃপঃ।।
অর্থাৎ উড়িষ্যার রাজা সুধন্ব  শঙ্করাচার্যের প্ররোচনায় অবৌদ্ধ প্রজাগণের প্রতি এই আদেশ প্রচার করলেন যে, সেতু বন্ধ রামেশ্বর  হতে হিমাদ্রির মধ্যবর্তী বিশাল সম্রাজ্যে যত বৌদ্ধ আবালবৃদ্ধবণিতা আছে,সব হত্যা কর,যে হত্যা করবে না,তাকে হত্যা করা হবে।এই আদেশের তৎপরতায়

বৌদ্ধেরা সব ধ্বংস।পক্ষান্তরে শঙ্করের বিরূদ্ধ-বাদী এক শ্রেণীর ভারতীয় লোক প্রচার করতেন যে, “মায় বাদং অসৎ শাস্ত্রম্‌ প্রচ্ছন্নম্‌ বৌদ্ধমেব চ”-মায়াবাদ নামে যে অসৎ শাস্ত্র শঙ্করাচার্য কতৃক প্রচারিত হচ্ছে,বস্তুতঃ তা বৌদ্ধ মতবাদ।শঙ্করাচার্য প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ। আবার দেখা যায়,-শঙ্করাচার্যস্বয়ং দশাবতার স্ত্রোত্রে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে যেই প্রাণঢালা শ্রদ্ধা,আবেগ ও অর্চনা জ্ঞাপন করেছেন,-তা অপূর্ব।তিনি বলেছেন,-
                   ধরাবদ্ধ পদ্মাসনাং ঘ্রি যষ্ঠিঃ
                   নিয়ম্যানিলং ন্যস্ত নাসাগ্রদৃষ্টি।
                   যঃ আস্তে কলৌ যোগিনাং চক্রবর্তী
                   স বুদ্ধ প্রবুদ্ধ’স্ত নঃ চিত্তবর্তী।।
          অর্থাৎ যিনি বুদ্ধরূপে অবতীর্ণ হয়ে মহীমণ্ডলে প্রাণায়াম সাধনা করে নাসাগ্রে দৃষ্টি স্থাপনপূর্বক পদ্মাসনে উপবিষ্ট,যিনি যোগীবৃন্দের অগ্রগণ্য যোগীরূপে কলিযুগে অবতীর্ণ; সেই বুদ্ধ আমাদের আন্তরে অধিষ্ঠিত হউন।অথচ শঙ্করাচার্যের বিরুদ্ধে দুই বিপরীতমুখী অপবাদ প্রচলিত এবং তথাগত বুদ্ধের প্রতি তাঁর সবীয় রচনা হল-এই।আসল কথা,-শঙ্করাচার্যের জন্মস্থান কেরল প্রদেশ ভারতের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত।দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণ ও উদীচ্য ব্রাহ্মণগণের মধ্যে দীর্ঘদিন ব্যাপী সামাজিক বিবাদ ছিল।আনন্দগিরি ও মাধবাচার্য প্রভৃতি উদীচ্য ব্রাহ্মণগণের বিবদমান মনোভাবেই শঙ্করাচার্যের বিরূদ্ধে এসব শাস্ত্রের প্রণয়ন ও অপবাদ রটিত হয়েছে।
          শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব কাল ৬৭৭-৭২০খৃষ্টাব্দ। তাঁর অব্যবহিত পরবর্তী কালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যগণের রচিত গ্রন্থে,তিব্বতীয় ঐতিহাসিক লামা তারানাথের ভারত কাহিনীতে, চৈনিক পরিব্রাজকগণের ভারত বিবরণে,সিংহলেপ্রণিত বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস-শাসন বংশের কোথাও শঙ্করের বিরূদ্ধে বৌদ্ধ ধর্ম পতনের জন্য কোনরূপ উদ্ধৃতি নেই।বড়ই বিস্ময়কর বিষ্য যে,যদি সত্যই ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের বিলোপের জন্য শঙ্করাচার্য দায়ী

থাকতেন তবে পরবর্তী কালের এতগুলো বৌদ্ধ লেখার মধ্যে ঘুণাক্ষরেও কি কোন উল্লেখ থাকত না? বস্ততঃ এসব অপবাদ সত্য নহে।এজন্য রাহুল সাংকৃত্যায়ন ঐতিহাসিক প্রমাণ ও নানা যুক্তি-তর্কে শঙ্করকে বৌদ্ধ ধর্ম বিলোপের অপবাদ থেকে মুক্ত করেছেন।
          রাহুলজী পুস্তিকার নবম পৃষ্ঠায় লিখেছেন,-“গৌড়াধিপতি তো পশ্চিম দেশীয়দের বিহার-বাংলা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম ও শিল্পকলার সংরক্ষক ছিলেনএক্ষেত্রে গৌড়াধিপতি সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্ক হওয়াই সম্ভব।যেহেতু এই উদ্ধৃতির পূর্বাপর প্রসঙ্গ সপ্তম শতকেই চলতেছিল.তা হলে রাজা শশাঙ্কের সম্পর্কে যে অনুরূপ একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে,আশা করি এক্ষেত্রে তার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
          কর্ণ সুবর্ণের(বর্তমান মুর্শিদাবাদ)রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধ ধর্মের ঘোরতর বিরোধী ছিলেনরাজা শশাঙ্ক যখন কর্ণ সুবর্ণের রাজা,তখন হর্ষ-বর্দ্ধন শীলাদীত্য থানেশ্বরের রাজা ছিলেন।উভয়ের রাজত্ব কাল সপ্তম শতকের প্রথম ভাগ।যখন পরস্পরের মধ্যে ভীষণ রাষ্ট্রীয় বিরোধ চলতে ছিল,এমন সময় চীন দেশীয় পরিব্রাজক হিয়-এন-সাং বৌদ্ধ ধর্মের পীঠ স্থান ভারত ভ্রমণে এসে হর্ষ-বর্দ্ধনের রাজ সভায় উপস্থিত হন।হর্ষ-বর্ধন তাঁকে সসম্মানে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন-পূর্বক থানেশ্বরে অবস্থানের অনুরোধ জানালেন।হিউ-এন-সাং এখানে বসে তাঁর বিবরণে লিপিবদ্ধ করলেন যে গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক ঘোরতর বৌদ্ধ বিরোধীঅতঃপর হিউ- এন-সাং ক্রমশ: পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণ-সুবর্ণে যখন উপনীত হলেন,তখন রাজা শশাঙ্ক জীবিত ছিলেন না।এখানে বেশ কিছুকাল অবস্থান করে লিপিবদ্ধ করেন যে,কর্ণ-সুবর্ণে ১০টি বিহার সঙ্ঘারামে দুহাজারের উপরে ভিক্ষু শ্রমণ সুখ-শান্তি সহকারে ধর্ম চর্চায় নিরত আছেন।তিনি বর্ণনা করলেন,-কর্ণ-সুবর্ণের সামাজিক সুষ্ঠু রীতি-নীতি,মানুষের সুসংযত আচার ব্যবহার ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাহিনী।এমন কি খোদ রাজা

শশাঙ্কের ও ভূয়সী প্রশংসা করতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি।এক্ষেত্রে হিউ-এন-সাংয়ের উদ্ধৃত একটি মজার গল্প বড় প্রণিধানযোগ্য।
দাক্ষিণাত্যের এক অতি বিজ্ঞ দাম্ভিক পণ্ডিত কর্ণ-সুবর্ণে এলেন।পরনে ছিল বিচিত্র পোশাক।তাঁর মাথায় বাঁধা থাকত একটা জ্বলন্ত  মশাল।তাঁর পেটটা থাকত তামার পাত দিয়ে বাঁধা। হাতে একটা প্রকাণ্ড লাঠি নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বুক ফুলিয়ে কর্ণ-সুবর্ণে ঘুরে বেড়াতেন।লোকে প্রশ্ন করলে বলতেন,অজ্ঞানান্ধকারে যারা দুনিয়ায় পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে,তাঁদেরই পথ প্রদর্শনের জন্য তাঁর মাথায় মশাল ধারণ আর অগাধ শাস্ত্র-জ্ঞানের চাপে পেট ফেটে যেতে পারে-এই ভয়ে তামার পাতে পেট বন্ধনের ব্যবস্থা  করতে হয়েছে।এখবরে রাজা শশাঙ্ক বিস্মিত  হয়ে দাম্ভিক পণ্ডিতকে শাস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ করার মানসে তর্কের ব্যবস্থা করেছিলেন।দাম্ভিক পণ্ডিতের সাথে তর্কে অবতীর্ণ হতে প্রথমত কেউ রাজী হলেন না।অবশেষে তর্কে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন তাঁরই রাজধানীর এক বৌদ্ধ শ্রামণ তর্ক-যুদ্ধে দাম্ভিক পণ্ডিত বৌদ্ধ শ্রমণের কাছে হার মেনে গেলেন।তাতে রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধ শ্রমণের প্রতি অতীব সন্তুষ্ট হলেন এবং একটি সঙ্ঘারাম নির্মাণ পূর্বক বিজয়ী শ্রমণকে দান করেছিলেন।
এতে বুঝা গেল যে,হিউ-এন-সাং-এর পূর্ববর্তী উক্তি ও পরবর্তী বিবরণ কথঞ্চিৎ সামঞ্জস্য-হীন।এতে এরূপ মনে করা অযৌক্তিক নহে যে,থানেশ্বরে পৌঁছার আগে যদি তিনি কর্ণ-সুবর্ণে পৌঁছতেন কিংবা শশাঙ্কের সাথে হর্ষ-বর্দ্ধনের রাষ্ট্রীয় বিবাদ না থাকত তবে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে ঘোরতর বৌদ্ধ ধর্ম বিরোধী বলে কোন অপবাদ  উঠত না।মহারাজ শশাঙ্ক সম্পর্কে বৌদ্ধ শর্ম বিরোধী ধ্বংসাত্মক কার্য-কলাপের অপবাদ সচরাচর যা প্রচলিত,তা ঐতিহাসিক বিচারে অতিরঞ্জিত বলে বাংলাদেশী প্রত্ন-তত্ত্ব বিভাগের প্রধান পরিচালিত ডাঃ নাজিমুদ্দিনাহমদ মন্তব্য করেছেন।
বৌদ্ধ ধর্ম-শাস্ত্র ও সাধন মার্গকে প্রধানত: তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়,-থেরবাদ বা হীনযান,মহাযান ও তন্ত্র যান।খৃঃপূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে
খৃষ্টীয় প্রথম শতকের পূর্ব পর্যন্ত-এই পাঁচ শতাধিক বৎসর হীন-যানের অভ্যুদয় কাল।খৃষ্টীয় প্রথম থেকে সপ্তম শতক পর্যন্ত এই সাত শত বৎসর মহাযান পন্থী বৌদ্ধ ধর্মের প্রবল প্রতিপত্তি এবং অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক-এই পাঁচ শত বৎসর তন্ত্র যানের প্রাদুর্ভাব কাল নিরূপিত হয়েছে।এই ত্রিবিধ যানেরই বিরাট সাহিত্য,সাধক পরম্পরা ও কৃষ্টি সংস্কৃতির প্রবল প্রভাব।হীনযানী বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্র পালি ভাষায় এবং মাহাযানী ও তন্ত্রযানী শাস্ত্র গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় লিখিত।
          রাহুল সাংকৃত্যায়ণের মতে-ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের বিলোপ সাধন ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতকে আরম্ভ হলেও তার কারণ গড়ে উঠেছে বহুকাল আগের থেকে।বৈশালীর দ্বিতীয় সঙ্গীতির পর থেকে বৌদ্ধ ধর্মে বহু মতবাদের সৃষ্টি হওয়ায় অনুসারীরা বহু দল-উপদলে বিভক্ত  হয়ে পড়ে।কনিষ্কের আমল থেকে মূর্তি গড়া আরম্ভ হয়।বুদ্ধ বোধিসত্ত্বের জীবনাদর্শের সাধনা ছেড়ে দেবতা-জ্ঞানে তাঁদের পূজার্চনা শুরু হল।তাছাড়া, অসংখ্য দেব-দেবতার সৃষ্টি করে অদান্য ধর্মের উপাস্য দেব-দেবতার সংখ্যা অতিক্রম করে ফেলল।।জীবন দুঃখের অবসান ঘটাবার উদ্দেশ্যে বুদ্ধ-প্রদর্শিত সাধন-মার্গ পরিত্যাগপূর্বক পূজার্চনার নানা বিধি আবিষ্কার করল এবং মহা ধূমধামে পূজার্চনা আরম্ভ হয়ে গেল।বোধি-জ্ঞান,নির্বাণ মুক্তি কঠোর সাধন-সাপেক্ষ রইল না।পূজার্চনার মাধ্যমে নির্বাণ-মুক্তি সুলভ সহজ সরল বলে বিবেচিত হল।মহাযান ও তন্ত্রযান বৌদ্ধ ধর্মে ধারনী,মঞ্জুশ্রী মূল কল্প,গুহ্য সমাজ,চক্র সংবর এবং তৎসম্পর্কিত ব্রতশ্চারণ,বলি-পূজা,পুরশ্চরণ ইত্যাদি তপ-জপ ও তন্ত্র-মন্ত্রের প্রভাবে বৌদ্ধ ধর্ম এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছল,-যার ফলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রকৃত সত্তা বৈশিষ্ট্য ও মৌলিক আদর্শ উৎপাটিত হয়ে বৈদিক ধর্মের পুনর্জাগরণের বিরাট সহায়তা করল।বৌদ্ধ ধর্মের মূল আদর্শ ধরে রাখার মহানব্যাক্তিত্বের অভাব ঘটল।এভাবে ধর্মের বিলোপ সাধিত হল।

অষ্টম শতাব্দী থেকে চৌরাশি সিদ্ধার আবির্ভাব।শুধু চৌরাশি নহে সংখ্যায় আরও কত শতসিদ্ধা,যাঁরা উল্লেখ-যোগ্য,তাঁদের নাম একটা তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে।সিদ্ধাগণ অধিকাংশ বাঙ্গালী ছিলেন।তাঁদের রচিত চর্যাপদ,দোঁহা,ছড়ায় যে বিরাট সাহিত্য সৃষ্টি করল,এগুলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মূল উৎস বলে বাঙ্গালী শিক্ষাবিদগণ একবাক্যে স্বীকৃতি দিয়েছেন।কিন্তু রাহুলজী কতিপয় সিদ্ধাকে বিদ্বান প্রতিভাশালী কবি বলেও বর্ণনা করেছেন।আবার তাঁদের অসংযত আচার নিষ্ঠা,জীবন-জীবিকা,রীতি-নীতি লক্ষ্য করেই সম্ভবত: আধা-পাগল নামেও আখ্যায়িত করেছেন।মূল পুস্তকে বর্ণিত পন্‌হী-পা,কমরী পা,দমরু পা ও ওখরী-পা প্রভৃতি সিদ্ধাগণ ও চৌরাশি সিদ্ধার অন্তর্ভুক্ত।যেই কর্ম-ধারার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধাগণ পূর্বোক্ত নামে বিশেষিত,জন সাধারণের মধ্যে পরিচিত-সেই কর্ম ধারা আধ্যাত্মিক সাধনোচিৎ নহে।শব্দগুলোর ব্যুৎপত্তি-গত অর্থেই প্রমাণিত হয় যে,রাহুলজীর মন্তব্য যথার্থ।এই পা বা ফা শব্দটি আমাদের পারিপার্শ্বিক ত্রিপুরা,আরকানি ভাষায় আছে-যার প্রতিশব্দ বাংলা ভাষায় পিতা বা বাবা।এটা কখনো নামের পরে,কখনো বা কর্মানুসারে পদবীর পরে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়,-যেমন কাহ্নু-পা,হাড়ি-পা,(সিদ্ধাগণ),রত্ন-ফা,আচুঙ্গ-ফা,(রাজা-গণ)।বস্ততঃ পা বা ফা শব্দটি সম্মানসূচক সম্বোধনে  ব্যবহৃত শব্দ।আধুনিক জী শব্দ তুল্য,যেমন,বাবা-জী,গুরু-জী,স্বামী-জী,মহাত্মা-জী।
          রাহুলজী একচেটিয়া কোন ব্যাক্তি,সম্প্রদায় কিংবা জাতির উপর দোষারোপ করেন নি।তিনি বৌদ্ধ ধর্মের উন্নতি ও অবনতি সম্পর্কে সন-শতক-সহকারে ও ধারাবাহিকভাবে যে সব যুক্তি ও কারণ বিদ্রূপে বর্ণনা করেছেন,তাঁর বর্ণনাই সঠিক বলে পণ্ডিত মহলের বিশ্বাস।তাঁর বর্ণনার অন্তর্নিহিত মর্মার্থ হল,-তথাগত বুদ্ধ কঠোর সাধনায় বোধি-জ্ঞান লাভ করে যে ধর্ম প্রবর্তন করলেন,তাঁর মহাজ্ঞানী শ্রাবক সঙ্ঘ চরিত্রের গাম্ভীর্যে,কঠোর জ্ঞান সাধনায় সে ধর্মের প্রচার প্রতিষ্ঠা করেছেন।বহু শতাব্দী পর যখন বৌদ্ধ ধর্মে বহু মতবাদের সৃষ্টি হল?অনুসারীগণ শতধা বিচ্ছিন্ন হয়ে
গেল,বিশেষ করে,হীন,নীচাশয়,দুর্নীতি পরায়ণ,অত্যাচারী ভিক্ষু নাম ধারীদের বুদ্ধের ধর্ম-শাসনে আগমন হল,বাহ্যিক ঘাত-প্রতিঘাত আরম্ভ হল,হিংসা হত্যা লুণ্ঠনের তাণ্ডব লীলা সংঘটিত হল,তখনই বৌদ্ধ ধর্ম আপন জন্মভূমি ভারত বর্ষ হতে নির্বাসিত হয়ে গেল।
এ জগত কার্য-কারণ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।বিনা কারণে কোন কাজ হয় না।একটি কাজ সংঘটিত হবার পেছনে বহুবিধ কারণ থাকতে পারে।শুধু একটি কারণে একটা কাজ সিদ্ধ হয় না।অনুকূল কারণে গড়ে ও প্রতিকূল কারণে ভাঙ্গে।বৌদ্ধ ধর্মের বেলায়ও এই নীতি অপ্রযোজ্য নহে।একটি গৃহ খুঁটির উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে ও স্থিত থাকে।খুঁটি যতদিন মজবুত থাকে,ততদিন ঘূর্ণিঝড়েও পতিত হয় না।খুঁটি নষ্ট হয়ে গেলে  সামান্য বাতাসেও গৃহ চুরমার হয়ে যায়।বাতাস এখানে গৃহ পতনের মূল কারণ নহে,উপসর্গ মাত্র।বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থা ভারতে তা-ই হল।
কত কত লেখক নিজেকে বা নিজের সম্প্রদায়কে বাঁচিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে উদর পিণ্ডি বুদর ঘাড়ে”-একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের বিলোপের কারণ নির্দেশ করেছেন,-যেমন অতীতে,তেমনি বর্তমানে।সম্প্রতি আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া কর্তৃক সম্পাদিত গুপী চন্দ্রের সন্ন্যাসনামক গ্রন্থ বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে।যাকারিয়া সাহেব বৌদ্ধ ধর্মের বিলোপের একটা নূতন কারণ উদ্ভাবন করেছেন।গ্রন্থের পঁচানব্বই পৃষ্ঠায় লিখেছেন,-“এদেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রায় মরে গেছে।বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সামান্য এলাকা ছাড়া বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব আর কোথাও নেই।এদেশে বৌদ্ধ ধর্মের বিলুপ্তির একটা প্রধান কারণ যে বর্মণ-সেন রাজাদের নির্যাতন তাতে সন্দেহ নেই।কিন্তু নিরস নির্বাণ বা শূন্যতা বাদী বৌদ্ধ ধর্মের বিলুপ্তির বীজ যে সেই ধর্মের মধ্যেই লুক্কায়িত ছিল-এ যুক্তি ঠেলে ফেলে দেওয়া যায় না।ঝুনা নারকেলের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে রস ও রসদ সংগ্রহ করা সবার

শোবার পক্ষে সম্ভব হয় না।নিরস বৌদ্ধ ধর্মের সাথে যখন মন্ত্রের যাদু শক্তির সংযোগ ঘটল এবং পৌরাণিকদের দেব দেবীরা তাদের যৌন রসের কাহিনী নিয়ে আস্তানা গাড়ল,তাতে যে রসের আবির্ভাব ঘটল-তাতে নাথ ধর্মের বেঁচে থাকার পথ সুগম হল
বড়ই আশ্চর্য যে,বৌদ্ধ রাজা মহারাজা,ধর্ম-সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ক একটা বিরাটকায় গ্রন্থ দীর্ঘদিন ব্যাপী সম্পাদন করেও যাকারিয়া সাহেব বৌদ্ধ ধর্ম রস পেলেন না।তিনি বাংলাদেশের সামান্য এলাকা ও স্বল্প সংখ্যক বৌদ্ধের প্রতি লক্ষ্য করেই বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব বিলোপের বিচার করলেন।কিন্ত বিশ্বের মানব জাতির বৃহত্তম সংখ্যা যে আজও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী-পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ ভূ-খণ্ড যে আজও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর অধ্যুষিত দেশ;সেদিকে তিনি মোটেই লক্ষ্য করলেন নাযাকারিয়া সাহেব যুক্তিতে বললেন-বৌদ্ধ ধর্ম নিরস;কিন্ত উপমায় বললেন-ঝুনা নারকেলের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে রস-রসদ সংগ্রহ করা সকলের পক্ষে সম্ভবপর হয় না।উপমা দ্বারা তিনি বৌদ্ধ ধর্মের রস-রসদ স্বীকার করলেন।তাঁর যুক্তি ও উপমা সামঞ্জস্যহীন।দিনাজপুর থেকে শ্রী বরদা ভূষণ চক্রবর্তীর লিখিত একখানি পত্র যাকারিয়া সাহেব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে তাঁর আলোচ্য গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন;যেহেতু এই পত্রে বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের মিথ্যা অবাস্তব কুৎসা বর্ণিত আছে।
বৌদ্ধ ধর্ম বিলোপের যে নূতন কারণ তিনি নির্দেশ করেছেন,তা নিতান্ত অযৌক্তিক অবান্তর এবং বৌদ্ধ ধর্মের মৌলিক নীতির উপর প্রচণ্ড আঘাত।মৌলিক নীতির  দোষারোপ রূপে যাকারিয়া সাহেবের উক্তি অপূর্ব।যাকারিয়া সাহেবের জানা থাকা উচিৎ যে,প্রচুর অভিজ্ঞতা,নিরপেক্ষ দৃষ্টি ও সংস্কার মুক্ত বিচার বুদ্ধি নিয়ে অন্য ধর্ম শাস্ত্রের সমালোচনায় প্রবৃত্ত না হলে নিছক অদূরদর্শিতার পরিচয় হয়।অনেক ক্ষেত্রে, তেঁতুল ও গুড় মিশ্রিত শ্মশ্রুতে অম্ব-রসের স্বাদ-আস্বাদন করা হয় মাত্র।

তথাগত বুদ্ধ ছয় বৎসর কঠোর সাধনা প্রভাবে উপলব্ধি করে ঘোষণা করলেন,-নিব্বানং পরমং সুখং নিব্বানং অমতং পদং।বিশ্বের জ্ঞান-ভাণ্ডারে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি বিষয়ক বিশ্ব-বিখ্যাত যে সব গ্রন্থ রয়েছে,তার অধিকাংশ গ্রন্থ অবৌদ্ধ মনীষী-বৃন্দের অক্ষয় অবদান।তাঁরা বৌদ্ধ ধর্ম-সংস্কৃতির আলোচনা গবেষণাকে সারা জীবনের ব্রতরূপে গ্রহণ করেছিলেন।এই দৃষ্টান্ত আমাদের বর্তমান বাংলাদেশেও বিরল নহে।
          বৈজ্ঞানিক যেমন কার্য-কারণের বিশ্লেষণ পূর্বক জাগতিক প্রত্যেক ঘটনার বিশ্লেষণ করে থাকেন।কার্য-কারণের ব্যাখ্যা করে বাস্তবতাকে সঠিকভাবে প্রতিপাদন করাই বৈজ্ঞানিকের লক্ষ্য।অবান্তর রস সংযোজনা করে সাধারণ লোকের স্থূল-বুদ্ধির খোরাক যোগান বৈজ্ঞানিকের উদ্দেশ্য নহে।বৈজ্ঞানিকের উদ্দেশ্য-একটা বস্তুর যথার্থ সত্য উপলব্ধি করে তৎ-সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা।জ্ঞান লাভ হলেই মানুষের জীবনে গ্রাহ্য গ্রহণের ও ত্যাজ্যকে ত্যাগের জন্য বিচার বুদ্ধি জাগে।তদ্রূপ তথাগত বুদ্ধও জীবন প্রবাহের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কার্য-কারণ প্রদর্শন করেছেন,য বৌদ্ধ শাস্ত্রে দ্বাদশ নিদান নামে অভিহিত।নীতির দিক দিয়ে যা কার্য-কারণ প্রবাহ;উপলব্ধি ও প্রচারের দিক দিয়ে তা-ই অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম্য কিংবা জগতের লাক্ষণিক সত্য।জীবন রহস্যের উদ্ভেদে এটাই বুদ্ধের ধর্মের মূলা দর্শ।তাতে অনাবশ্যক রস কল্পনা অবান্তর।
কালের বিবর্তনে জগতের সব কিছু গতিশীল,পরিবর্তনশীল,উত্থান ও পতনশীল।অনিত্যতা জগতের স্বাভাবিক ও অকাট্য বিধান।অনিত্যতার গর্ভে জগতের সব কিছুকেই একদিন বিলীন হতে হয়।এক সময় ভারত-বর্ষে বৌদ্ধ ধর্ম সগৌরবে প্রচার প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।প্রায় দুহাজার বছর

যাবত ছিল এর প্রবল প্রভাব প্রতিপত্তি।অতঃপর ভারত-বর্ষে বৌদ্ধ ধর্ম স্তিমিত হোল বটে;কিন্ত বহির্ভারতের সর্বত্র ধর্মের ব্যাপক অভ্যুদয় ঘটল।কবি দ্বিজেন্দ্র লালের ভাষায়,উড়িল যেখানে বুদ্ধ আত্মা মুক্ত করিতে মোক্ষ-দ্বার,আজিও জুড়িয়া অর্ধ জগত ভক্তি-প্রণত: চরণে তাঁর।
একথা একান্ত সত্য যে,মহাকালের এক মহান ঢেউয়ের পতনই আরেক মহান ঢেউয়ের পুনরুত্থানের উৎস।বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব যেমন অসীম,তেমনি পতনের রহস্যও ঐতিহাসিক তথ্যে পরিপূর্ণ।জনমানব থেকে সাময়িকভাবে অপসারিত হলেও একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি।বৌদ্ধ ধর্ম ভারতের সর্বত্র শিলা-লিপিতে,পর্বত-বক্ষে,তাম্র-শাসনে,স্থাপত্য-ভাস্কর্যে,শিল্পকলায়,সংগ্রহ শালায় ও সাহিত্য-সংস্কৃতি রূপে অক্ষ স্মৃতি বহন-পূর্বক মহাকালকে জয় করে আছে।বর্তমান ভারত বর্ষে ইতিহাসের এক নূতন দিক উন্মোচিত হয়েছে।ধর্মের পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন যেভাবে জন-প্রিয়তা ওজাতীয় মর্যাদা লাভ করে চলছে,তাতে নিঃসন্দেহে এই প্রতীতি জন্মে যে,বৌদ্ধ ধর্মের কালজয়ী অক্ষ অবদানে আবার ভারতের ইতিহাসকে প্রভাবান্বিত করবে।
আমার বিদ্যা-বুদ্ধি অত্যন্ত সীমিত।বিশেষত: হিন্দি ভাষায়।রাহুলজীর বিরাট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও জ্ঞান-গর্ভ গ্রন্থ-রাজি প্রায়ই হিন্দি ভাষায় লিখিত।কোন ভাষায় এত অল্প জ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-তত্ত্ব সাধারণত: পঠন-লিখিত হয় না।তথাপি সমুদ্র দর্শনে কূপ-মণ্ডূকের লম্ফ-ঝম্পের ন্যায় আমার ক্ষীণ আগ্রহ।আমি এই পুস্তিকার বঙ্গানুবাদ করেছি বটে;কিন্ত অনুবাদের যে নিয়ম,আমা দ্বারা তা হয় নি।আক্ষরিক,ভাবার্থ কিংবা ব্যাখ্যামূলক অনুবাদের কোন দিকেই সঠিকভাবে রক্ষিত হয় নি।অনুবাদ কার্যে আমি সর্বদা বোঝবার সুবিধার দিকেই লক্ষ্য রেখেছি।তথাপি বজ্রযান,তন্ত্রযান,মন্ত্রযান,সহজযান,কাল চক্রযান সম্পর্কিত এমন সব পারিভাষিক শব্দ আছে যা আমি নিজেও বুঝিনি।সব বিষয়ের সঠিক বিবরণ দিতে গেলে দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ ও বহু খাটুনির প্রয়োজন।পুস্তিকাটি আকারে নিতান্ত

ছোট বটে;কিন্ত ইহার প্রতিপাদ্য বিষয় অতীব গম্ভীর।একে সর্বাঙ্গ-সুন্দর ও সহজ-বোধ্য করতে হলে ভূমিকার কলেবর বিরাট হয়ে দাঁড়ায় তাতে আবার আর্থিক সমস্যার প্রশ্ন।
প্রকাশনার উদ্দেশ্যে, সরকারী অনুমতি লাভের আবেদন না করে দুবৎসর পূর্বে এই পুস্তকের পাণ্ডুলিপি প্রেসে দেওয়া হয়েছিল।বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সঙ্ঘ তথা এশীয় বৌদ্ধ শান্তি সংস্থার বাংলাদেশ জাতীয় কেন্দ্রের সহ-সভাপতি মাননীয় শ্রীমৎ প্রিয়ানন্দ মহাথের এই পুস্তক প্রকাশের জন্য একশত তাকা দান করেছিলেন।তাতে পুস্তকের কিয়দংশ মুদ্রিতও হয়েছিল।সরকারী অনুমতি ভিন্ন এই পুস্তক বের করা যুক্তি সঙ্গত হবে না বিবেচনায় পাণ্ডুলিপি প্রেস থেকে ফেরত নিয়ে আসি এবং সম্প্রতি সরকারী অনুমতি লাভ করে পুনরায় প্রেসে দিয়েছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য-বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পূজনীয় মহাস্থবির শীলাচার শাস্ত্রী মহোদয়,বাংলাদেশ কৃষ্টি প্রচার সঙ্ঘ তথা এশীয় বৌদ্ধ শান্তি সংস্থার বাংলাদেশ জাতীয় কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক শ্রীযুক্ত বাবু বিমলেন্দু বড়ুয়া ও সঙ্ঘের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কেন্দ্রের সাধারণ সভাপতি শ্রীযুক্ত বাবু বিভূতি ভূষণ বড়ুয়া মহাশয় এই পুস্তকের  পাণ্ডুলিপি সংশোধন ও প্রয়োজনীয় উপদেশ প্রদান করেছেন।রাউজান নিবাসী মাষ্টার(সিলেট বাদশাগঞ্জ পাবলিক হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক) শ্রীযুক্ত বাবু ভুপেন্দ্র লাল বড়ুয়া মহাশয় কিছুদিন পূর্বে বাদশাগঞ্জ থেকে এই পুস্তকের আংশিক খরচ বাবত একশত টাকা পাঠিয়েছেন।
চট্টগ্রাম-কোটের পার নিবাসী ডাঃ অরবিন্দ বড়ুয়ার মাতৃ-দেবী শ্রীমতী বিমলাময়ী বড়ুয়া তাঁর স্বামী স্বর্গীয় মাষ্টার শ্রীমন্ত বড়ুয়ার পুণ্য স্মৃতি সংরক্ষণার্থ এই পুস্তকের  সম্পূর্ণ ব্যয়-ভার বহন করে ধর্ম দানের অধিকারী হলেন।ধম্মদানং সব্বদানং জিনাতি।বুদ্ধ বাক্যের অন্তর্নিহিত সার-ধর্ম দান অপর দানকে জয় করে।
যাঁরা এই পুস্তকের অপবাদ কার্যে ও প্রকাশনায় নানাভাবে সাহায্য করেছেন,আমি তাঁদের নিকট কৃতজ্ঞ।তাঁদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি।
          মহা পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের  ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান-পতনপুস্তিকাটি পাঠ করে সমাজ যদি সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, ভারতে কিভাবে বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করল,কেনই বা অপসারিত হয়ে গিয়েছিল,ভারত-বাংলার বৌদ্ধ ধর্ম ও বাঙ্গালী বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গৃহী সমাজের বর্তমান পরিস্থিতি বা কিরূপ?তবেই অনুবাদ কার্যের পরিশ্রম ও প্রকাশনার ব্যায়-ভার সফল হয়েছে মনে করব।
সব্বে সত্তা ভবন্ত সুখিতত্তা
-জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।


                                                                                       
      শ্রী জ্যোতিঃপাল মহাথের          
                   অধ্যক্ষ,
                                                                                     বরইগাঁও পালি পরিবান,                                                                                                              পোঃ-ভোরা জগৎপুর,
মধু পূর্ণিমা,২৫২৩ বুদ্ধাব্দ                                                          লাকসামকুমিল্লা
১৯৭৯ইং                                                                           














নমো বুদ্ধায়
ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান-পতন
        বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তি হয় ভারতবর্ষে।ইহার প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ কোসী-কুরু-ক্ষেত্রে ও হিমাচল বিন্ধ্যাচলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বিচরণ পূর্বক ৭৫ বৎসর ব্যাপী ধর্ম প্রচার করেছিলেন।এই ধর্মের অনুসারী মহান সম্রাটগণ হতে আরম্ভ করে সাধারণ লোকজনের মধ্যে পর্যন্ত দীর্ঘকাল যাবত সমগ্র ভারত বর্ষে বিপুলা-কারে ইহা বিস্তার লাভ করেছিল।ধর্মের সাধক ভিক্ষুদের মঠ-মন্দির ও বিহার ছাড়া দেশের খুব বিরল অংশই রিক্ত ছিল।বৌদ্ধ ধর্মের বিচারক ও দার্শনিক পণ্ডিতগণ হাজার হাজার বৎসর যাবত আপন বিচার প্রভাবে ভারতীয় বিচারকে প্রভাবান্বিত করেছিল।এই ধর্মের শিল্পকলা বিশারদগণ ভারতীয় শিল্পকলার মধ্যে অপরিমিত ছাপ রেখেছিলেন।এই ধর্মের ধর্মের ভাস্কর্য ও স্থাপত্য বিদ্যায় পারদর্শীগণ হাজার হাজার বর্ষ পর্যন্ত সজীব পর্বত বক্ষকে মোমের মত কর্তন করে অজন্ত,ইলোরা,কার্লে ও নাসিক প্রভৃতি গুহা মন্দিরগুলো যে অত্যাশ্চর্য-ভাবে প্রস্তত করেছিলেন তার গম্ভীর তাৎপর্য অবগত হওয়ার জন্য যবন ও চীনাদের মত সমুন্নত জাতি আগ্রহান্বিত হয়েছিলেন।এই ধর্মের ও সদাচার সম্মত নিয়ম-নীতিকে প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বের সমগ্র বিদ্বান ব্যক্তি অতীব শ্রদ্ধা-যুক্ত দৃষ্টিতে দেখে থাকেন।এই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যার সাথে তুল্য অন্য কোন ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা আজও বিদ্যমান নেই।
          এরূপ প্রভাব প্রতিপত্তি শালী বৌদ্ধ ধর্ম আপন মাতৃভূমি ভারতবর্ষ হতে কিরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেল? ইহা বড়ই গুরুত্বপূর্ণ ও আশ্চর্যজনক প্রশ্ন।এই প্রশ্নের উপর আমি এখানে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান-পতনের সংক্ষিপ্ত-রূপে বিচার করব।ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের বিলোপ সাধন ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতক









থেকে আরম্ভ হয়েছে।এসময়ের স্থিতি কাল অবগতের জন্য কতেক প্রাচীন ইতিহাস জানা প্রয়োজন।
          গৌতম বুদ্ধের নির্বাণ প্রাপ্তি ঘটেছে-খৃষ্ট পূর্ব ৪৮৩ অব্দে(স্থবির বাদীর মতে ৪৯৫অব্দে)।তিনি সমগ্র ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন মৌখিক।শিষ্যগণ তাঁর জীবদ্দশায়ই কণ্ঠস্থ করে নিয়েছিলেন।এই উপদেশ ছিল দ্বিবিধ-১)সাধারণ ধর্ম ও দর্শন এবং ২)ভিক্ষু-ভিক্ষুনী গণের নিয়ম নীতি;প্রথমোক্ত উপদেশকে পালিতে বলা হত ধম্ম(ধর্ম)।দ্বিতীয়ত বিনয়।বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর তাঁর প্রধান শিষ্যবৃন্দ ভবিষ্যতে মতভেদের আশঙ্কায় সেই বৎসরেই রাজ গৃহের সপ্তপর্ণী গুহায় সমবেত হয়েছিলেন এবং ধর্ম বিনয় সঙ্গায়ন করেছিলেন।এই সম্মেলনকে বৌদ্ধ শাস্ত্রে বলা হয় প্রথম সঙ্গীতি।ইহাতে ভিক্ষু সঙ্ঘের প্রধান মহাকশ্যপের বিচক্ষণ পরিচালনায় বুদ্ধের অনুচর-শিষ্য আনন্দ স্থবিরকে ধর্ম বিষয়ক ও বুদ্ধ প্রশংসিত উপালি স্থবিরকে বিনয় বিষয়ক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা-পূর্বক ধর্ম বিনয় সঙ্গায়ন করা হয়েছিল।অহিংসা,সত্য অচৌর্য,ব্রক্ষ্মচর্য ইত্যাদি সৎকর্মকে পালি ভাষায় বলা হয়-শীল।রূপাদি স্কন্ধ,চক্ষু বিজ্ঞানাদি আয়তন,পৃথিবী জল ইত্যাদি ধাতুকে সূক্ষ্ম দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণে প্রজ্ঞা,দৃষ্টি বা দর্শন বলা হয়।বুদ্ধের উপদেশ শীল ও প্রজ্ঞা-এই দুই বিষয়ের উপর সম্পূর্ণ জোর দেওয়া হয়েছিল।ধর্ম শব্দের আরেকটি প্রতিশব্দ পালি ভাষায় পাওয়া যায়,তা হচ্ছে-সুত্ত,সূক্ত,সূত্র কিংবা সূত্রান্ত।প্রথম সঙ্গীতি কারক স্থবিরগণ  এই প্রাকারের ধর্ম ও বিনয় সংগ্রহ করেছিলেন।পরবর্তী কালে বিভিন্ন ভিক্ষু এই ধর্ম বিনয় পৃথক ভাবে কণ্ঠস্থ করে অধ্যয়ন অধ্যাপনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।এভাবে যাঁরা ধর্ম বা সূত্র সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন,-তাঁরা ধর্মধর,সূত্রধর বা সৌত্রান্ত্রিক নামে এবং বিনয় সংরক্ষণের ভার নিয়েছিলেন,তাঁরা বিনয়ধর নামে অভিহিত হতেন।তদতিরিক্ত সুত্রে দর্শন সম্পর্কিত অংশটুকু কোন কোন ক্ষেত্রে বড়ই সংক্ষিপ্ত রূপে ছিল,-তা মাতিকা নামে কথিত।মাতিকা রক্ষক;মাতিকাধর নামে  পরিচিত।পরবর্তীকালে এই মাতিকাগুলো বিশদ রূপে বোধগম্যের জন্য যখন বিস্তারিত ভাবে বর্ণিত হয়,তখন ইহা অভিধর্ম নাম ধারণ করে।ইহার সংরক্ষকগণ আভিধার্মিক নামে কথিত।







প্রথম সঙ্গীতির একশত বছর পরে খৃষ্ট পূর্বে ৩৮৩অব্দে বৈশালীর ভিক্ষুগণ বিনয়ের কিছু নিয়মের অবহেলা করতে শুরু করলেন।ইহা অবলম্বনে বিবাদের সূত্রপাত হয়।অতঃপর ভিক্ষু-সংঘ পুনরায় একত্রিত হয়ে বিবদমান বিষ্যের উপর আপন আপন মত প্রকাশ করলেন এবং ধর্ম বিনয় সঙ্গায়ন করলেন।এই সম্মেলনের নাম দ্বিতীয় সঙ্গীতি।কিছু সংখ্যক ভিক্ষু এই সঙ্গীতিতে একমত হতে পারলেন না।তাঁরা কৌশম্বীতে মহাসংঘ নাম দিয়ে পৃথক সম্মেলন আহ্বান করলেন এবং আপন আপন মতানুসারে ধর্ম-বিনয় সংগ্রহ করলেন।সঙ্ঘস্থবিরের অনুগামী বলে প্রথম নিকায় আর্য স্থবির বা স্থবিরবাদ নামে আর দ্বিতীয় নিকায় মহাসাংঘিক নামে প্রসিদ্ধি লাভ করল।এই দুই সম্প্রদায় প্রথম সোয়া শত বৎসরের মধ্যে স্থবিরবাদ সম্প্রদায় হতে বজী-পুত্রক,মহীশাসক,ধর্ম গুপ্তিক,সম্মিতীয়,পান্নাগারিক,ভদ্র-যানিক,ধর্মোত্ত্রীয় এবং মহাসাংঘিক সম্প্রদায় হতে গোকুলিক,এক ব্যবহারিক,প্রজ্ঞপ্তিবাদ(লোকোত্তর বাদ)বাহু লিক,চৈতন্যবাদ-এই ১৮ প্রকার নিকায়ের উদ্ভব হল।তাদের মধ্যে পরস্পর মতভেদ ছিল বিনয় ও অভিধর্মকে ভিত্তি করে।কোন কোন নিকায় আর্য স্থবিরের ন্যায় বুদ্ধকে মানুষরূপে না মেনে অলৌকিক রূপে মানতে লাগলেন।বুদ্ধের মধ্যে অদ্ভুত ও দিব্য শক্তির সন্নিবেশ স্বীকার করতেন।কেহ কেহ শুধু বুদ্ধের জন্ম ও নির্বাণ সম্পর্কিত বাগাড়ম্বরে আস্ফালন করতেন।এভাবে বুদ্ধকে বিভিন্ন চক্ষে বিভিন্ন ভাবে স্বীকার করে নেওয়ার ফলে তাঁর সূত্র ও বিনয়ের মধ্যেও নানা পার্থক্য দেখা যেতে লাগল।বুদ্ধকে মানবাতীত লীলার অভিনেতা রূপে স্বীকার করায় নব নব সূত্রের রচনা হয়েছিল।বুদ্ধের নির্বাণের প্রায় সোয়া দুইশত বৎসর  পর সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।তাঁর গুরু মোগগলি-পুত্র তিষ্য সেই সময় আর্যস্থবির পন্থীদের সঙ্ঘ-স্থবির ছিলেন।তিনি ভিক্ষুদের মধ্যে মতভেদ নিরসন কল্পে পাটনায় অশোক নির্মিত অশোকারাম বিহারে ভিক্ষু-সঙ্ঘ কর্তৃক মনোনীত হাজার ভিক্ষুর এক সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন।তাঁরা মিলে বিবদমান বিষয় নির্ণয় ও ধর্ম বিনয় সংগ্রহ করেছিলেন।এই সম্মেলন বৌদ্ধ শাস্ত্রে তৃতীয় সঙ্গীতি নামে প্রসিদ্ধ।এসময় আর্যস্থবিরদাদ থেকে উদ্ভূত সর্বাস্তিবাদ নিকায়ের এক পৃথক সঙ্গিতি অনুষ্ঠিত হয় নালন্দায়।বুদ্ধ মাঝে মাঝে নালন্দায় অবস্থান করতেন বলে নালন্দা পবিত্র তীর্থস্থান রূপে







গণ্য হয়ে গিয়েছিল এবং এই সময় নালন্দ আ সর্বাস্তি বাদীর মুখ্য স্থানে পরিণত হয়েছিল।
          তৃতীয় সঙ্গীতি সমাপ্ত করার পর মোগ্‌গলিপুত্র তিষ্য সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠ-পোষকতায় বিভিন্ন দেশে ধর্ম প্রচারক পাঠিয়েছিলেন।সাংগঠনিক ভাবে ভারতীয় ধর্ম বহির্ভারতে যে প্রচারিত হয়েছিল,-এটাই ছিল সর্ব প্রথম অভিযান।এই ধর্মাভিযাত্রী দম পশ্চিমে গ্রীস,মিশর,সিরিয়া প্রভৃতি দেশ;উত্তরে মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণে তাম্র পর্ণী (শ্রীলঙ্কা) ও সুবর্ণ ভূমি(বার্মা,শ্যাম পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন।শ্রীলঙ্কায় অশোকের পুত্র তথা মোগ্‌গলিপুত্র  তিষ্যের শিষ্য ভিক্ষু মহেন্দ্র ও তাঁর  সহোদরা সঙ্ঘ-মিত্রা ধর্ম প্রচারার্থে গমন করেছিলেন।শ্রীলংকার রাজা  দেবানং প্রিয় তিষ্য তখন বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।কিছুদিনের মধ্যে সেখানকার সমগ্র জনগণই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।আর্য স্থবিরবাদের প্রচার প্রতিষ্ঠা তখনও প্রচার প্রতিষ্ঠা তখনও সেখানে চলতেছিল মাঝে দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে যখন বার্মা ও শ্যাম দেশে মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম বিকৃত জর্জরিত ও হ্রাস প্রাপ্ত হতে লাগল।তখন আর্য স্থবিরবাদ সেখানেও পৌঁছল।শ্রীলংকায়ই খৃষ্টীয় প্রথম শতকে সূত্র,বিনিয় ও অভিধর্ম  তিন পিটক-ত্রিপিটক যা কণ্ঠস্থ করার রীতি চলে আসছিল;তা লিপিবদ্ধ হল;ইহাই আধুনিক পালি ত্রিপিটক নামে বিখ্যাত।
          শৌর্য সম্রাট বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অতীব অনুরক্ত ছিলেন।এজন্য তাঁর জীবদ্দশায় অনেক পবিত্র স্থানে  হাজার হাজার স্তূপ সঙ্ঘারাম নির্মিত হয়েছিল।শ্রেষ্ঠীগণও  বড় বড় স্তূপ সঙ্ঘারাম তৈয়ারি করেছিলেন,যেখানে ভিক্ষুগণ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস পূর্বক ধর্ম প্রচারে ব্রতী হয়েছিলেন।খৃষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতকে মৌর্য সেনাপতি পুষ্যমিত্র অন্তিম মৌর্য সম্রাট (বৃহদ্রথ)কে হত্যা করে নিজকে রাজ্যাধিপতি ঘোষণা করেন এবং শুঙ্গ-বংশের রাজ্য স্থাপন করেন।এই নূতন রাজ বংশ রাজনৈতিক দৃষ্টি-ভঙ্গীর বিচারে ব্রাক্ষণ্য ধর্মের অকৃত্রিম অনুসারী ও অব্রাক্ষণ্য ধর্মের বিদ্বেষী ছিলেন।বহু শতাব্দীর পরিত্যক্ত পশু বলিময় অশ্ব-মেধাদি যজ্ঞ মহা ভাষ্যকার পতঞ্জলির পৌরহিত্যে পুনরায় অনুষ্ঠিত হতে লাগল।








ব্রাক্ষণদের  মাহাত্মেয় পরিপূর্ণ মনু,স্মৃতি প্রভৃতি গ্রন্থসমূহ রচনার  সূত্রপাত হয়েছিল।এই সময় মহাভারতের প্রথম সংস্করণ হয় তথা মৃত সংস্কৃত ভাষা পুনরুদ্ধার করা হয়।পরিস্থিতি অনুকূল না থাকায় ঘরে আবদ্ধ বৌদ্ধ জনগণ বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র সমূহ মগধ কোশল থেকে বিভিন্ন দেশে স্থানান্তরিত করতে বাধ্য হতে লাগল।আর্য-স্থবির বাদ মগধ থেকে সরে বিদিশার নিকট চৈত্য পর্বতে (বর্তমান সাঁচী চলে গিয়েছিল।সর্বাস্তি-বাদ মথুরার উরু মুণ্ড পর্বতে(গোবর্ধন)চলে গেল।এই প্রকারে অন্যান্য নিকায় সমূহ নিজ নিজ কেন্দ্র অন্যত্র হঠাতে বাধ্য হল।
          স্থবিরবাদ হচ্ছে সবচেয়ে  পুরানা নিকায় এবং প্রাচীন নীতিতে বড়ই কড়াকড়ি ভাবে সুরক্ষিত অন্যান্য নিকায়গুলো দেশ, কাল ও ব্যক্তি ইত্যাদি বিবেচনানুসারে অনেক পরিবর্তন করেছিল।আজ পর্যন্তও ত্রিপিটক মাগধী ভাষায় রয়েছে,যা উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশ বিহারের সাধারণ ভাষা ছিল।সর্বাস্তি বাদীরা মথুরায় পৌঁছেই আপনাদের ত্রিপিটক শাস্ত্রকে ব্রাক্ষণ প্রশংসিত সংস্কৃত ভাষায় পরিবর্তিত করেছিলেন।এরূপে মহাসক্তিক,লোকোত্তর বাদ আরও কয়েকটি নিকায় ও ত্রিপিটক সংস্কৃতে ভাষান্তরিত করলেন।আজকাল ইহাকে গাথা সংস্কৃত বলা হয়।
          মৌর্য সম্রাজ্য বিনষ্ট হওয়ার পর যবন্রাজ মিনান্দর পশ্চিম ভারত অধিকার করেছিলেন।মিনান্দর আপনার রাজধানী সাকলায়(বর্তমান শিয়ালকোট) স্থাপন করলেন।তিনি ও তাঁর বংশজ ক্ষত্রপ রাজারা মথুরা ও উজ্জয়িনীতে অবস্থানপূর্বক রাজ্য শাসন করতেন।যবন রাজারা অশিকাংশ বৌদ্ধ ছিলেন।সে জন্য উজ্জয়িনীর ক্ষত্রপ সাঁচীর স্থবির বাদীদের প্রতি এবং মথুরার ক্ষত্রপ সর্বাস্তিবাদীদের প্রতি বহু স্নেহ ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন।এই সময়ে মথুরা ক্ষত্রপের একমাত্র রাজধানীই ছিল না,অধিকন্তু এই মথুরা পূর্ব ও দক্ষিণ থেকে তক্ষশীলার বাণিজ্য পথে পথচারী লোকের প্রধান কেন্দ্র ও ব্যবসায়ের এক সমৃদ্ধ বন্দর ছিল।এজন্য সর্বাস্তি বাদের প্রচার কার্যের জন্য ইহা বড় সহায়ক হয়েছিল।মগধের সর্বাস্তিবাদে আর        







এখানকার মধ্যে কিছু পার্থক্য দেখা যায়।এজন্য এখানকার সর্বাস্তিবাদ আর্য সর্বাস্তিতবাদ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিল।
          যবনদিগকে পরাস্ত করে শকেরা পশ্চিম ভারত অধিকার করলেন।তাঁদের এক শাখা ছিল কুষাণ সেই কুষাণ বংশে প্রতাপশালী সম্রাট কনিষ্কের জন্ম হয়।কনিষ্কের রাজধানী পুরুষ পুর বা বর্তমান পেশোয়ার।এই সময় সর্বাস্তিবাদ গান্ধারে গিয়ে পৌঁছল। কনিষ্ক স্বয়ং সর্বাস্তিবাদের অনুসারী ছিলেন।এই সময়ে মহাকবি অশ্বঘোষ ও আচার্য বস্বুমিত্র প্রভৃতি জন্ম পরিগ্রহ করেন।এই সময়ে গান্ধারের সর্বাস্তিবাদ যা মূল সর্বাস্তিবাদ নামে প্রসিদ্ধ ছিল,-তা নিয়ে কাশ্মীর ও গান্ধার দেশীয় আচার্যদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হয়।দেবপুত্র কনিষ্কের সহায়তায় বস্বুমিত্র,অশ্বঘোষ প্রভৃতি আচার্যগণ সর্বাস্তিবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এক মহতী সভা আহ্বান করলেন।এই সভায় আপোষে মতভেদ নিরসন করার মানসে তাঁরা আপন ত্রিপিটকের উপর বিভাষা নামে এক টীকা লিখেছিলেন।এই বিভাষার অনুসারী হওয়াতে মূল সর্বাস্তিবাদীর আরেক নাম বৈভাষিক।বৌদ্ধ ধর্মে দুঃখ থেকে মুক্তি পথের যাত্রীদের জন্য নির্বাণের তিনটি রাস্তা নির্দেশিত  হয়েছে।(১) যিনি শুধু স্বয়ং দুঃখ মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেন এবং আর্য-অষ্টাঙ্গিক মার্গে আরূঢ় হয়ে জীবন মুক্তি লাভ করেন-তিনি অর্হৎ(অরিকে যিনি হত্যা করেছেন)নামে অভিহিত।(২) যিনি তদপেক্ষা অধিকতর পরিশ্রম করতে প্রস্তত  হন এবং সাধনা প্রভাবে জীবন্মুক্তি লাভ করেন,-তিনি প্রত্যেক(একক) বুদ্ধ এবং(৩) যিনি শুধু আপন মুক্তির জন্য নহে সর্ব জীবের পথ প্রদর্শক হওয়ার জন্য কঠোর সাধনা করেন এবং বহুকাল পরে সেই মার্গ দ্বারা স্বয়ং প্রাপ্য নির্বাণ উপলব্ধি করেন,তিনি সম্যক সম্বুদ্ধ নামে খ্যাত। এই তিন রাস্তাই যথাক্রমে অর্হৎ বা শ্রাবক-যান,প্রত্যেক বুদ্ধযান ও সম্যক সম্বুদ্ধ নামে কথিত।কোন কোন আচার্য প্রথমোক্ত দ্বিবিধ যান অপেক্ষা  বুদ্ধ যানের উপর বড় জোর দিয়েছিলেন এবং ইহা মহাযান।এরূপে পরবর্তী কালে কিছু সংখ্যক লোক প্রথমোক্ত দুই যানকে স্বার্থ-পূর্ণ বলে শুধু বুদ্ধযান বা মহাযানের প্রশংসা করতে লাগলেন।একথা স্মরণ থাকা






প্রয়োজন যে,পূর্বোক্ত ১৮ প্রকার নিকায় এই ত্রিবিধ যান স্বীকার করতেন।তাঁদের বক্তব্য ছিল যে কোন যান নির্বাচন করা ____ব্যাক্তির আপন স্বাভাবিক রুচির উপর নির্ভরশীল।
          খৃষ্টীয় প্রথম শতকে যে সময় বৈভাষিক সম্প্রদায় আর্যাবর্তে বিস্তার লাভ করতেছিলেন,তখন দাক্ষিণাত্যের বিদির্ভ(বর্তামান বরার) রাজ্যে আচার্য নাগার্জুনের আবির্ভাব ঘটে।তিনি মাধ্যমিক বা শূন্য বাদ দর্শনের উপর গ্রন্থ লিখেছিলেন।কালান্তরে মহাযান ও মাধ্যমিক দর্শনের যোগে শূন্য বাদী মহাযান সম্প্রদায় চলতে থাকে। যেই ত্রিপিটকের আবশ্যকতা মাঝে মাঝে উপলব্ধ হয়ে আষ্ট সাহস্রিক  প্রজ্ঞা-পারমিতা প্রভৃতি গ্রন্থ পূরণ করেছিল।চতুর্থ শতকে পেশোয়ারের আচার্য বসু বন্ধু বৈভাষিক থেকে কিছুটা মতভেদ করে অভিধর্ম কোষ নামে গ্রন্থ লিখেছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ সহোদর  অসঙ্গ বিজ্ঞানবাদ  বা যোগাচার সম্প্রদায়ের প্রবর্তক ছিলেন।এরূপে চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধেরা বৈভাষিক সৌমান্তিক,যোগাচার ও মাধ্যমিক এই চার দার্শনিক সম্প্রদায় রূপে গঠিত ও রূপান্তরিত হয়।তন্মধ্যে প্রথম দুই সম্প্রদায়কে যাঁরা মানতেন,তাঁরা পূর্বোক্ত ত্রিবিধ যানকে মানতেন।এজন্য তাঁদেরকে মহাযান পন্থীরা হীন যানের অনুসারী বলতেন এবং অবশিষ্ট দ্বিবিধ সম্প্রদায় যুদ্ধ যানকেই মানতেন।তদ্ধেতু তাঁরা আপনাদিগকে মহাযান পন্থী বলতেন।
মহাযান পন্থীরা বুদ্ধ যানের একান্ত ভক্ত ছিলেন।শুধু তা-ই নহে,অধিকন্তু তাঁরা আপন আগ্রহাতিশয্যে অবশিষ্ট দ্বিবিধ যানকে ভাল-মন্দ বলতেও কুণ্ঠিত হতেন না।বুদ্ধের অলৌকিক চরিত্র তাঁদের কাছে বহু উপযুক্ত মনে হত।এজন্য তাঁরা মহাসাংঘিক ও লোকোত্তর বাদীদের অনেক মত গ্রহণ করেছেন।রত্ন-কুট ও বিপুল নামক বহু স্ত্রোত্র তাঁদের দ্বারা রচিত হয়েছে।বুদ্ধ যানের  উপর উত্তমরূপে আরূঢ় বুদ্ধত্ব লাভের অধিকারী প্রাণীকে বোধিসত্ত্ব বলা হয়।মহাযানের সূত্রগুলোর মধ্যে প্রত্যেককে বোধিসত্ত্বের মার্গানুযায়ী চলবার জন্য বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।প্রত্যেকের আপন মুক্তিলাভের যত্ন না করে জগতের সকল প্রাণীর মুক্তির







জন্য প্রযত্ন করা কর্তব্য বলে বিবেচিত।বোধিসত্ত্বের মাহাত্ম্য প্রদর্শনের জন্য যেখানে অবলোকিতেশ্বর,মঞ্জুশ্রী,আকাশ মার্গী প্রভৃতি মুক্ত অর্হৎ শিষ্যগণকে অমুক্ত ও বোধিসত্বরূপে প্রতীয়মান করা হয়েছে।ইহার সারাংশ এই যা,যে সকল প্রাচীন সূত্র ইত্যাদি পরম্পরাকে আঠার প্রকার নিকায় বলে স্বীকৃতি দেয়ে আসতেছিল,মহাযান পন্থীরা সেই সকলকে বোধিসত্ত্ব ও বুদ্ধ করবার প্রবণতায় একেবারে বিপরীত সাধনে কোনরূপ ত্রুটি করেন নি।
          কনিষ্কের সময় অর্থাৎ বুদ্ধের পরিনির্বাণের চার শত বৎসর পর সর্ব প্রথম বুদ্ধ মূর্তি নির্মিত হয়েছে।মহাযান ধর্ম প্রচারের সাথে যে ক্ষেত্রে বুদ্ধ প্রতিমার পূজার্চনার বাহুল্য জাঁকজমকপূর্ণ আকার ধারণ করে,সে ক্ষেত্রে শত শত বোধিসত্ত্বের প্রতিমা নির্মিত হতে লাগল।তাঁরা ব্রাক্ষণদের দেব-দেবীর ন্যায় এই সকল বোধিসত্ত্বের নিকট কামনা পূর্ণ করার জন্য সমর্পণ করতেন।তাঁরা প্রজ্ঞা পারমিতা অনেক দেব দেবীর কল্পনা করেছিলেন।স্থানে স্থানে এই এই দেবদেবী ও বোধিসত্ত্বের প্রতিষ্ঠার জন্য অতীব বিশাল মন্দির প্রস্তুত করেছিলেন।তাঁদের বহু স্ত্রোত্রাদি রচনাও হতে লাগল।এ সম্পর্কে এই সব লোকের এরূপ কল্পনাও আসে নি যে,তাঁদের এই কার্য-কলাপে প্রাচীন পরম্পরা ও  ভিক্ষু নীতির উল্লঙ্ঘন হতে চলছে।যখন কেহ কোনরূপ  প্রামাণ্য দলিল প্রদর্শন করেছে, অমনি তাকে বলে দেওয়া হয়েছে যে, বিনয়ের নিয়ম নীতি হচ্ছে,তুচ্ছ স্বার্থের পিছনে মরনেওয়ালা হীন যান পন্থীদের জন্য।সমগ্র জগতের মুক্তির জন্য জীবনে মরণে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ  বোধিসত্ত্বের নিকট  ঐ জাতীয় কোনরূপ অন্তরায় আসতে পারে না।মহাযান পন্থীরা হীনযানী সূত্র অপেক্ষা আপনাদের অধিকতর মাহাত্ম্যপূর্ণ সূত্র প্রস্তত করেছিলেন।শত শত পৃষ্ঠার সূত্র-সমূহ পাঠ করা খুব তাড়াতাড়ি হতে পারে না।এজন্য তাঁরা প্রত্যেক সূত্রের দুতিন পঙক্তিতে ছোট ছোট ধারণী প্রস্তত করেছিলেন,যেমন ভাগবতের চতুঃশ্লোকী গীতা।এই ধারণীগুলোকে আরও সংক্ষিপ্ত করে মন্ত্রের সৃষ্টি করা হয়েছিল।এই প্রকারে ধারণী বোধিসত্ত্ব ও তাদের অনেক  দিব্য শক্তি,প্রাচীন পরম্পরা এবং






পিটকীয় নিয়ম নীতির ওলট-পালটে  নিঃসঙ্কোচ উৎসাহ সৃষ্ট হয়েছিল।গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রারম্ভিক কাল থেকে হর্ষ বর্দ্ধনের সময় পর্যন্ত মঞ্জুশ্রী মূল কল্প,গুহ্য-সমাজ ও চক্র-সংবর ইত্যাদি অনেক তন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল।পুরানা নিকায় সমূহের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সরলতার সহিত আপন মুক্তির উদ্দেশ্য অর্হৎযান  ও প্রত্যেক বুদ্ধ যানের রাস্তা উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল।মহাযান পন্থীরা সকলের জন্য সু দুশ্চর বুদ্ধ যানেরই একমাত্র রাস্তা করে রেখেছিল।ভবিষ্যতে তার কঠোরতাকে দূর করার জন্য তাঁরা ধারনী ও বোধিসত্ত্বের পূজার বিধি আবিষ্কার করেছিলেন। এই প্রকারে যখন সরল সহজ দিকের মার্গ খুলতে লাগল তখন তার আবিষ্কারের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে লাগল।মঞ্জুশ্রী মূল কল্প তন্ত্রের জন্য উপায় উদ্ভাবন করে দিল।গুহ্য-সমাজ আপন ভৈরবী-চক্রের শবার,স্ত্রী-সংভোগ তথা মন্ত্রোচ্চারণ দ্বারা আরও সরল সহজ করেছিল।এ সব মতবাদ মহাযানের ভিতর থেকেই বের হল।কিন্তু প্রথমত: ইহার প্রচার ভিতরে ভিতরেই চলতেছিল। ভৈরবী চক্রের সব কারবার গোপন রাখা হয়েছিল।প্রবেশাকাঙ্ক্ষীকে কত সময় পর্যন্ত যে উমেদারি করতে হত।অনেক শিক্ষা-দীক্ষা ও পুনঃ পুনঃ পরীক্ষা-নিরীক্ষার  পর ঐ ব্যক্তি সমাজে মিলিত হতে সক্ষম হত।এই মন্ত্রযান (তন্ত্রযান,বজ্রযান) সম্প্রদায় এই প্রকারে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত গুপ্ত  রীতিতে চলে এসেছিল। ইহার অনুসারীরা বাহ্যিক ভাবে নিজেদের মহাযানী আখ্যায় প্রকাশ করতে লাগল।মহাযানীরা আপনাদের পৃথক বিনয় পিটক তৈয়ার করতে পারে নি।এ জন্য এই পন্থার ভিক্ষুগণ সর্বাস্তিবাদ ইত্যাদি নিকায়ে দীক্ষা দিতে শুরু করলেন।অষ্টম শতাব্দীতেও যখন নালন্দা মহাযানীদের কেন্দ্র ছিল,সেখানকার ভিক্ষুরা সর্বাস্তিবাদের বিনয়ের অনুশীলন করতেন।সেখানকার ভিক্ষুদিগকে সর্বাস্তিবাদের বিনয়ানুসারে মহাযানের বোধিসত্ত্ব চর্যার বিধানে এবং বজ্রযানের ভৈরবীচক্র মতে দীক্ষা গ্রহণ করতে হত।
অষ্টম শতাব্দীতে ভারতের সমগ্র বৌদ্ধ সম্প্রদায় এক প্রাকার বজ্রযান গর্বিত মহাযানের অনুসারী হয়ে গিয়েছিলেন।বুদ্ধের সাদা-সিধে শিক্ষার প্রতি তাঁদের বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল।অধিকন্তু তাঁরা মনগড়া হাজার







         
হাজার অলৌকিক কথায় বিশ্বাস করতেন।বাহ্যত ভিক্ষুদের চিবর পরিধানের মধ্যেও তাঁরা তাঁরা ভিতরে ভিতরে গুহ্য-সমাজী ছিলেন।বড় বড় বিদ্বান ও প্রতিভা-শালী কবি আধা পাগল হয়ে,চৌরাশি শিদ্ধায় পরিণত হয়ে সান্ধ্য ভাষায় নির্গুণ গান করতেন।অষ্টম শতাব্দীতে উড়িষ্যার রাজা ইন্দ্র-ভূতি এবং তাঁর গুরু সিদ্ধা স্ত্রীলোকদিগকে মুক্তি-দাত্রী প্রজ্ঞা,পুরুষকে মুক্তির উপায়,শরাবকে অমৃত রূপে সিদ্ধ করার জন্য আপনাদের পাণ্ডিত্য ও সিদ্ধির আস্ফালন জাহির করতেন।অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম বস্ততঃ বজ্রযান বা ভৈরবী-চক্রের ধর্ম ছিল।মহাযানের ধারনী ও পূজার্চনা  দ্বারা নির্বাণকে সুগম করা হয়েছিল।বজ্রযান ত ইহাকে একেবারে সহজ করে দিয়েছিল।এজন্য পূর্ববর্তী বজ্রযান পরবর্তী কালে সহজ নামে অভিহিত হতে লাগল।
          বজ্রযান পন্থী বিদ্বান ও প্রতিভা-শালী কবি চৌরাশি সিদ্ধাগণ বিলক্ষণ বেশে বিচরণ পূর্বক অবস্থান করতেন। কেহ পন্‌হি বা পাদুকা তৈয়ার করতেন বলে পন্‌হী-পা,কেহ কম্বল দিয়ে সর্বাঙ্গ আবৃত করে অবস্থান করতেন বলে কমরী-পা কেহ দমরু বাজাতেন বলে দমরু-পা,কেহ বা ওখল বা কাষ্ঠ নির্মিত (বাদ্য) যন্ত্র রাখতেন বলে ওখরী-পা নামে অভিহিত হতেন।এশোব লক ছীলেণ মোড-মাটাল।মানুষের মাথার খুলি নিয়ে তারা শ্মশান কিংবা বিকট জঙ্গলে বাস করতেন।জন সাধারণকে তাঁরা যতই শাসন করতেন,ততই লোকজন তাঁদের পিছনে ধাবিত হত।মানুষ বোধিসত্বের প্রতিমা ও অন্যান্য দেব-দেবীর ন্যায় এই সিদ্ধাগণকে অদ্ভুত ক্ষমাতা ও দিব্য শক্তি সম্পদে শক্তিশালী মনে করতেন।তাঁরা প্রকাশ্যভাবে স্ত্রী ও শরাব উপভোগ করতেন। রাজা মহারাজগণ নিজ কন্যা পর্যন্ত তাঁদেরকে দান করতেন।এসকল লোক ত্রাটক(hypnotism) প্রক্রিয়ায় কিছু অভ্যস্ত ছিলেন।এসবের প্রভাবে আপনাদের অত্যন্ত সাদা সিধে অনুসারীগণকে কখন কখন কিছু কিছু ভোজ বিদ্যা প্রদর্শন করতেন।কখন কখন হাতের ছাপাই তথা শ্লেষ-যুক্ত অস্পষ্ট কণ্ঠ স্বরে জনতার মধ্যে নিজেদের অদ্ভুত কৃতিত্ব প্রকাশ করতেন।এই পাঁচশত বৎসরে ধীরে ধীরে এক তরফা সমগ্র ভারতীয়






জনগণ তাঁদের খপ্পরে পড়ে কাম-ব্যসনী,মদ্য ও অন্ধ বিশ্বাসী হয়ে গেল।রাজা-মহারাজা যেখানে রাজ্য রক্ষার্থে পল্টন নিযুক্ত করেছিলেন সেখানে কিছু সংখ্যক সিদ্ধাচার্য তথা তাঁদের শত শত তান্ত্রিক অনুসারীগণের রক্ষার্থে বহু ব্যয় সাধ্য পল্টন মোতায়েন করতেন।দেব-মন্দিরে সর্বদা বলি-পূজা সম্পাদিত হত।লাভ-সৎকার দ্বারা উন্মুক্ত হলে ব্রাক্ষণ ও অন্য ধর্মানুসারীগণও বহুলাংশে তাঁদের অনুসরণ করতে লাগলেন।
          ভারতীয় জনগণ যখন এই প্রকার দুরাচার ও অন্ধ বিশ্বাসের গভীর পঙ্কে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল,তখন ব্রাক্ষণেরা জাতি ভেদে পুঞ্জীভূত বিষ-বীজকে শত শত বর্ষ-ব্যাপী সেই জাতির মর্মমূলে টুকরো টুকরো বাটরা করে ঘোরতর গৃহ কলহের সৃষ্টি করে রেখেছিল।শত শত বর্ষব্যাপী শ্রদ্ধালু রাজা প শ্রেষ্ঠীগণ শ্রদ্ধা দান করতে করতে মঠ-মন্দিরে অপার ধনরাশি স্তূপাকার করেছিলেন।এমন সময় পশ্চিম দেশীয় লোকেরা আক্রমণ শুরু করলেন।তাঁরা শুধু মঠ-মন্দিরের অপার ধন সম্পদই লুণ্ঠন করলেন না;দিব্য-শক্তির মালিক অগণিত দেব-মূর্তিও চুরমার করে ফেলল।তান্ত্রিক লোকেরা মন্ত্র,তন্ত্র,বলি ও পুরশ্চন প্রয়োগ করতেই রইল,কিন্তু এতে আক্রমণকারীদের কোনরূপ বাঁধা দিতে পারল না।ত্রয়োদশ শতক আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুর্কী বীরেরা সমস্ত উত্তর ভারত আপনাদের হস্তগত করল।বিহারের পাল বংশীয় রাজারা রাজ্য রক্ষার্থে ওদন্তপুরীতে এক তান্ত্রিক বিহার নির্মাণ করেছিলেন।মোহাম্মদ বিন বক্তিয়ার মাত্র দুই শত অশ্বারোহী সেনা নিয়ে ইহা জয় করেছিলেন।নালন্দার অদ্ভুত শক্তি-শালিনী তারা টুকরো টুকরো করে ফেলে দেওয়া হল।তলোয়ারের আঘাতে নালন্দা ও বিক্রমশীলার শত শত তান্ত্রিক ভিক্ষুর শিরশ্ছেদ করে তারা চলে গেল।যদিও এই যুদ্ধে অপার ধন-জনের পরি হানি ঘটেছিল,অপার গ্রন্থরাজি ভস্মীভূত হয়েছিল।শত শত শিল্প-কলার উৎকৃষ্ট আদর্শ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল,তথাপি এই যুদ্ধে একটা মস্ত বড় লাভ হল এই জনগণের মন থেকে ভোজ-বাজির স্বপ্ন চিরতরে অপসারিত হয়ে গিয়েছিল।








বহু কাল থেকে একটা কথা চলে আসছে যে,শঙ্কুরাচার্যের প্রতাপেই বৌদ্ধেরা ভারত থেকে বহির্গমন করল।শঙ্কর শুধু শাস্ত্রার্থেই বৌদ্ধ দিগকে পরাস্ত করেন নি,অধিকন্তু তাঁর আজ্ঞায় রাজা স্বুদস্বা প্রভৃতি হাজার হাজার বৌদ্ধকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছিলেন এবং তলোয়ার দ্বারা তাদের শিরশ্ছেদ পূর্বক সংহার করিয়েছিলেন।এই কথা শুধু দন্ত কথা বা বাদকে বাদ নহে,এর সত্যতা আনন্দ গিরি ও মাধবাচার্যের(শঙ্কর দিগ্বিজয়) নামক পুস্তকে রয়েছে।তদ্ধেতু সংস্কৃতজ্ঞ বিদ্বান এবং অন্য শিক্ষিত লোকও এই কথায় বিশ্বাস করতেন এবং ইহাকে ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্যরূপে মনে করতেন।আবার কিছু সংখ্যক লোক এতে শঙ্করের প্রতি ধর্মীয় অ-সহিষ্ণু তার কলঙ্ক আরোপিত হয় দেখে তা মেনে নিতে অস্বীকার করেন।কিন্ত তা যদি সত্য হয়,তবে তাঁর অপলাপ না করাই উচিত।
          শঙ্করের সময় কাল নিয়েও মত-বিরোধ আছে।কিছু সংখ্যক লোক তাঁকে বিক্রমের সমকালীন মেনে থাকেন।Age of Shankar এর সম্পাদক ও পুরানানুসারে পণ্ডিতগণের ইহাই অভিমত।কিন্ত ঐতিহাসিকগণ এই অভিমত মানেন না।তাঁরা বলেন,শঙ্করের শারীরিক ভাষ্য নামক গ্রন্থের উপর বাচস্পতি মিশ্র ভামতীটীকা লিখেছিলেন।বাচস্পতি মিশ্রের সময় হচ্ছে খৃষ্টীয় নবম শতাব্দী।তাঁর নিজ গ্রন্থের দ্বারাই তা প্রমাণিত।এজন্য শঙ্করের সময় যে নবম শতাব্দীর পূর্বে,তা নিশ্চিত।কিন্ত শঙ্কর কুমারিণ ভট্ট থাকে পূর্বেকার হতে পারেন না ।কুমারিন বৌদ্ধ নৈয়ায়িক ধর্ম-কীর্তির সম-সাময়িক ছিলেন,যিনি সপ্তম শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।তা হলে শঙ্কর সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকের লোক হতে পারেন না।শঙ্কর কুমারিন ভট্টের সম-কালীন ছিলেন এবং দুজনেই একে অন্যের সাক্ষাৎকার পেয়েছিলেন।এই কথা আমরা দিগ্বিজয়থেকে পেয়ে থাকি।এতে অন্তিম কথা হল এই,তাঁর নিজ গ্রন্থের মাধ্যমে যতদূর জানা যায়,তাতে কোনরূপ প্রমাণ মিলে না।
          হিউএন সাং(সপ্তম শতাব্দী) এর পূর্ববর্তী এরূপ কোন প্রবল বৌদ্ধ বিরোধী শাস্ত্রার্থীর পরিচয় পাওয়া যায় না।যদি পরিচয় পাওয়া যেত,





তবে হিউএন সাং অবশ্যইতাঁর ভারত বিবরণে তা লিপিবদ্ধ করতেন।যদি এই কথা বলা যায় যে,শঙ্করাচার্য ভারতের দক্ষিণ সীমান্তে জন্ম পরিগ্রহ করেছিলেন এবং তাঁর কর্মক্ষেত্রও দক্ষিণ ভারতই ছিল।তবে দক্ষিণ ভারতের বৌদ্ধগণের উপর উপরোক্ত অত্যাচার হওয়া সম্ভব।কিন্ত এই কথাও ঠিক নহে। কেননা ,ষষ্ঠ শতাব্দীর পরেও কাঞ্চী-কাবেরী বন্দরে অবস্থানকারী আচার্য ধর্মপাল প্রভৃতি বৌদ্ধ পালি গ্রন্থকার আবির্ভূত হয়েছিলেন।যাঁর কর্মতৎপরতার নিদর্শন আজও সিংহল প্রভৃতি দেশে সুরক্ষিত আছে। সিংহলের ইতিহাস গ্রন্থ মহাবংশরাজনৈতিক ইতিহাস অপেক্ষা শর্মীয় ইতিহাসের অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে থাকে।শঙ্করাচার্যের জন্মস্থান কেরল দেশ এবং দ্রাবিড় দেশ সিংহলের খুব নিকটবর্তী।যদি এরূপ কোন কথা সত্য হত,তবে মহাবংশে এ সম্পর্কে উল্লেখ না থাকার কোনরূপ যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না।বৌদ্ধ ঐতিহাসিকগণের লেখায় শঙ্করের শাস্ত্রার্থ পর মৌন থাকার প্রেক্ষিতেই এই কথার চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া যায় যে এই সকল ঘটনা বস্ততঃ সংঘটিতই হয় নি।অধিকন্তু রামানুজ প্রভৃতি চরিত্রের  মধ্যে ভিন্ন মতাবলম্বীদের সাথে এরূপ ব্যবহার দেখে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক।
          আসল কথা হল,-শঙ্করাচার্য দাক্ষিণাত্যে একজন প্রতিভাশালী পণ্ডিত ছিলেন।তিনি শারীরিক ভাষ' নামক গ্রন্থ লিখেছিলেন।সেই ভাষ্য এক নূতন বিষয় সম্পর্কিত ছিল এবং এতে বহু দার্শনিক সিদ্ধান্তের উপর যুক্তির অবতারণা ছিল।দিঙনাগ,উদ্যোতকর,কুমারিল,ধর্মকীর্তি প্রভৃতি মনিষীবৃন্দের যুগে এরূপ উচ্চাঙ্গের গ্রন্থ আর ছিল না। এসময় কেরল ও দ্রাবিড় দেশবাসীদের সঙ্গে উত্তর ভারতীয়দের বিরোধ ছিল।এই বিরোধ সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি যদি আমরা সপ্তম শতাব্দীর মহাকবি বাণভট্টের কাদম্বীর সেই অংশটুকু পাঠ করি-যেই অংশে শবরের সাথে কোন এক জঙ্গলে এক দ্রাবিড় ব্রাক্ষণ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছিল।বস্ততঃ উত্তর ভারতীয় পণিতমণ্ডলী ছিলেন; ততক্ষণ পর্যন্ত শঙ্করকে আচার্য রূপে মানবার জন্য উদীচ্য ব্রাক্ষণগণ প্রস্তত ছিলেন না,যতক্ষণ পর্যন্ত উত্তর ভারতীয় দার্শনিক






পণ্ডিতদের প্রধান কেন্দ্র-মিথিলার সম-সাময়িক অদ্বিতীয় দার্শনিক,সর্বশাস্ত্র পারদর্শী বাচস্পতি মিশ্র শারিরীক ভাষ্যের টীকা ভামতীলিখে শঙ্করকে সঠিক রূপে উপলব্ধি করার যুক্তিসমুহ করেন নি। বস্ততঃ বাচস্পতির কাঁধে চড়েই শঙ্করের খ্যাতি ও শ্রেষ্ঠত্ব লাভ,-যা আজ কাল দেখা যায়।যদি তিনি ভামতীনা লিখতেন,তবে শঙ্করের শারীরিক ভাষ্য কবে উপেক্ষিত ও বিলুপ্ত হইয়ে যেত এবং আজ ভারতে শঙ্করের গৌরব ও প্রভাব প্রতিপত্তির কথাই বা কি?বাচস্পতির উত্তর ভারতীয় পণ্ডিতমণ্ডলীর সামনে শঙ্কর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।বাচস্পতি মিশ্র হতে এক শতাব্দী পূর্বে নালন্দায় আচার্য শান্তি রক্ষিত আবির্ভূত হয়েছিলেন।তাঁর মহান দার্শনিক গ্রন্থ তত্ত্ব সংগ্রহসংস্কৃত ভাষায় লিখিত হয়েছে এবং বরোদা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থ রত্নের মধ্যে শান্তরক্ষিত আপনার থেকে পূর্ববর্তী পঞ্চাশ জন দার্শনিক ও দর্শন সম্পর্কিত গ্রন্থের সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত করে খণ্ডন-মণ্ডন করেছেন। যদি বাচস্পতি মিশ্র থেকে পূর্বেই শঙ্কর আপন বিদ্যাবত্তা ও দিগ্বিজয় দ্বারা প্রসিদ্ধ হয়ে থাকেন,তবে কোন কারণ নেই যে শান্তরক্ষিত ইহার স্মরণ করেন নি।আরেকটা কথা বলা যায় যে-শঙ্কর বৌদ্ধদিগকে ভারত বর্ষ থেকে মেরে পিটে তাড়িয়ে ছিলেন।কিন্ত আমরা দেখতে পাই-গৌড়দেশে (বিহার বাংলা) পাল বংশীয় বৌদ্ধ রাজাদের প্রচণ্ড প্রতাপের বিস্তার এবং এই সময় উদন্তপুরী (বিহার শরীফ) ও বিক্রম শীলা যেমন বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,তেমনি এই সময় ভারতীয় বৌদ্ধদের তিব্বতে ধর্ম-বিজয় করতেও আমরা দেখি।একাদশ শতাব্দীর পূর্বোক্ত প্রবাদানুসারে ভারতে যখন কোন বৌদ্ধ থাকার কথা নয়,তখন তিব্বত থেকে কতিপয় বৌদ্ধ পরিব্রাজক ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন।তাঁরা সব জায়গায় বৌদ্ধ ও ভিক্ষুগণকে দেখতে পেয়েছিলেন।পাল যুগের বুদ্ধ,বোধিসত্ত্ব ও তান্ত্রিক দেব-দেবীর হাজার হাজার খণ্ডিত মূর্তি উত্তর ভারতের গাম্বোতকের মধ্যে পাওয়া গিয়েছে।মগধ,বিশেষ করে,গয়া জেলায় এমন গ্রাম খুব কমি দেখা যায়,যেখানে এ যুগের মূর্তি পাওয়া যায় না।গয়া জেলার জাহানাবাদ মহকুমায় কোন







কোন গ্রামে এই সকল মূর্তিতে ভরপুর।কম্পা,ঘেঞ্চল ইত্যাদি গ্রামে তো অনেক বুদ্ধ,তারা,অবলোকিতেশ্বর প্রভৃতির মূর্তি-যাতে ঐ সময়কার কুটিল অক্ষরে যে ধর্মা হেতু প্রভবা.........শ্লোকে অঙ্কিত প্রমাণ পাওয়া যায়।এতে একথা বুঝা যায় যে,সেই সময় শঙ্কর বৌদ্ধদিগের কোন প্রকার ধ্বংস করেন নি বলেই এই সম্পদ পাওয়া গিয়েছিল।এই কথা সারা উত্তর ভারতে প্রাপ্ত তাম্রক-লেখ ও শিলা-লেখদ্বারা প্রমাণিত হয়।গৌড়াধিপতি পশ্চিমদেশীয়দের বিহার বাংলা বিজয় পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম  ও শিল্পকলার মহান সংরক্ষক ছিলেন।অন্তিম কাল পর্যন্ত তাঁর তাম্র-পট বুদ্ধ ভগবানের সর্ব প্রথম ধর্মোপদেশের স্থান মৃগদাবের (সারনাথ) লাঞ্ছন দুই মৃগের মধ্যে রক্ষিত চক্র দ্বারা অলঙ্কৃত হয়েছিল।গৌড়-দেশের পশ্চিমে ছিল কান্যকুজ্ব রাজ্য।উহা যমুনা হতে গণ্ডক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।সেখানকার জনগণ ও নৃপতিগণের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম খুব সম্মানিত ছিল।জয়চন্দ্রের দাদা গোবিন্দ চন্দ্রের জেতবন বিহার দান করে পঞ্চ গ্রামের দান পত্রের দ্বারা এবং তাঁর রাণী কুমার দেবীর নির্মিত সারনাথের মহান বৌদ্ধ মন্দির দ্বারা প্রমাণিত হয়।গোবিন্দ চন্দ্রের পৌত্র জয়-চন্দ্রের প্রধানা রাণী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিনী ছিলেন।যাঁর উদ্দেশ্যে প্রজ্ঞা পারমিতা সম্পর্কিত লিখিত পুস্তক আজও নেপাল দর্বার পুস্তকালয়ে রক্ষিত আছে।কনৌজে গহড়বার রাজাদের আমলের কত কত বৌদ্ধ মূর্তি পাওয়া যায়,যা আজ কোন না কোন দেব-দেবতা রূপে পূজিত হয়ে থাকে।
কলিগঞ্জরের রাজন্য বর্গের সময়ে নির্মিত্মহোবা ইত্যাদি হতে প্রাপ্ত সিংহ-নাদ,অবলোকিতেশ্বর প্রভৃতি সুন্দর সুন্দর মূর্তি দ্বারা একথা প্রমাণিত হয় যে,তুর্কীদের আগমনের সময় পর্যন্ত বুন্দেল খণ্ডে বৌদ্ধদের বিরাট সংখ্যা তথায় ছিল।দক্ষিণ ভারতে দেব গিরির (দৌলতাবাদ,নিজান) পাশে ইলোরার বিখ্যাত গুহা প্রাসাদের মধ্যে কত কত বৌদ্ধ গুহা ও মূর্তি যা মলিক-কাফুর থেকে কিছু সময় পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল।নাসীকের পাণ্ডব লেনীর কিছু সংখ্যক গুহার সম্পর্কেও এ যুক্তি প্রযোজ্য।তবে কি এরূপ সিদ্ধান্ত অমূলক নহে যে শঙ্কর দ্বারা বৌদ্ধ ধর্মের দেশ-






নির্বাসন কল্পনা মাত্র।খোদ শঙ্করের জন্ম ভূমি কেরল হতে বৌদ্ধদের প্রসিদ্ধ তন্ত্র মঞ্জুশ্রী মূল কল্পসংস্কৃত ভাষায় পাওয়া যায়।যা ত্রিবেন্দ্রম্‌ হতে স্বর্গীয় মহা মহোপাধ্যায় গণ-পতি শাস্ত্রী প্রকাশ করিয়েছিলেন।তবে কি এই গ্রন্থের প্রাপ্তিতে একথা প্রমাণিত হয় না যে সমগ্র ভারত হতে শঙ্কর দ্বারা বৌদ্ধদের বহিষ্কার একটা অমূলক কথা খোদ কেরল থেকেও বৌদ্ধ ধর্ম বহু কাল পরে লুপ্ত হয়েছিল।এরূপ আরও  অনেক যুক্তি আছে,যা এ সম্পর্কে পেশ করা যেতে পারে,যদ্বারা ইতিহাসের পূর্বোক্ত মিথ্যা ধারণা খণ্ডিত হয়ে যেতে পারে।
          কিন্ত প্রশ্ন উঠে যে,তুর্কী বীরেরা তো বৌদ্ধ ও ব্রাক্ষণ উভয় মন্দির ধ্বংস করেছিল,পুরোহিতগণকে হত্যা করেছিল।তবে কি কারণ আছে যে ভারতে ব্রাক্ষণ আজও বিদ্যমান আর বৌদ্ধ যে নেই বললেও হয়?কথা হল যে ব্রাক্ষণ্য ধর্মে গার্হস্থও ধর্মের পরিচালক হতে পারেন।বৌদ্ধ ধর্মে ভিক্ষুদের উপরই ধর্ম প্রচার ও ধর্ম গ্রন্থ রক্ষণাবেক্ষণের ভার ন্যস্ত।ভিক্ষুগণ আপন চীবর ও মঠের নিবাস হতেই অনায়াসে নিহ্নিত হতেন।ইহাও একটি কারণ যে তুর্কীদের প্রারম্ভিক শাসন কালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অবস্থান মুস্কিল হয়ে পড়েছিল।ব্রাক্ষণদের মধ্যে যদিও বামপন্থী ছিলেন,কিন্ত সবাই নহে।বৌদ্ধদের মধ্যে তো সবাই ছিলেন বজ্রয়ানী।এই ভিক্ষুদের প্রতিষ্ঠা তাদের সদাচার আদর্শ ও বিদ্যার উপর নির্ভর ছিল না।ছিল তাঁদের তথা-কথিত তন্ত্র-মন্ত্র এবং দেবতাদের এই সব অদ্ভুত শক্তির দেওয়ান ধূলিসাৎ করেছিল।জন সাধারণ তখন হৃদয়ঙ্গম করতে লাগল যে , “আমরা এতদিন ধোকা-বাজিতে ছিলামএর ফল ফলল এই যে,যখন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিজেদের ধ্বংসীভূত মঠ মন্দির পুনরায় মেরামত করতে চেয়েছিলেন,তখন তজ্জন্য তাঁদের অর্থ মিলল না।বস্ততঃ এই সব দুরাচার মদখোর ভিক্ষুদিগকে  কে অর্থের থলে সমর্পণ করবে?যেহেতু তুর্কীদের অত্যাচার নিবন্ধন তখন লোকের নিকট একেকটি পয়সা বহু মূল্যবান বলে অনুভূত হচ্ছিল।ফলে বৌদ্ধরা আপনাদের ধ্বংস প্রাপ্ত ধর্মস্থান সমূহ মেরামত করতে







সক্ষম হতে পারে নি।তাতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিরাশ্রয় হয়ে পড়ল।ব্রাক্ষণদের সম্পর্কে এই কথা প্রযোজ্য নহে।তাঁদের মধ্যে সবাই অত্যাচারী ছিলেন না।তাঁদের বিদ্যা ও সদাচারের জন্য তাঁরা আপনাদের নষ্ঠীকৃত মঠ-মন্দির পুনশ্চ: তৈরির জন্য বহু অর্থ লাভ করেছিলেন।বারানসির পাশে বৌদ্ধদের অতীব পবিত্র তীর্থস্থান ঋষিপতন মৃগদাব(বর্তমান সারনাথ) সেখানকার খুদাই করা লিপি থেকে এই প্রতীতি জন্মে যে,কান্য-কুজ্বেশ্বর গোবিন্দচন্দ্রের রাণী কুমার দেবীর নির্মিত বিহার সেখানকার সর্বশেষ বিহার ছিল।তুর্কীরা যখন ইহা নষ্ট করে ফেলল,তখন তা পুনরায় নির্মাণের আর কোন যত্ন নেওয়া হয় নি।এটার পক্ষান্তরিক উদাহরণ,-বারানসির বিশ্বনাথ মন্দির একে একে চার বার নব চূড়ায় নির্মিত হল।সবচেয়ে  পুরানো মন্দির বিশ্বেশ্বরগঞ্জের নিকট অবস্থিত ছিল,এখন যেখানে মসজিদ,সেখানে শিব-রাত্রি তিথিতে আজও মানুষ পুণ্য কামনায় জল সিঞ্চন করে থাকে।এটা ধ্বংসের পর যেই মন্দির তৈরি হয়,তা হল আদি বিশ্বেশ্বর।এটাও ধ্বংস হলে জ্ঞানব্যাপীতে পুনশ্চ: নির্মিত হয়,যাঁর ধ্বংসিত অংশ আজও ঔরঙ্গজেবের মসজিদের নিকট দেখতে পাওয়া যায়।এই মন্দির যখন ঔরঙ্গজেব নষ্ট করে ফেলেছিলেন,তখন বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।
নালন্দা,ঔদন্তপুরী,জেতবন ইত্যাদি বৌদ্ধ পবিত্র স্থানেও আমরা দ্বাদশ শতকের পরবর্তী দালান-কোটা দেখতে পাই না।লামা তারানাথের ইতিহাসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে,বিহার সমূহ ধ্বংস করে ফেলার পর বিহারের আবাসিক ভিক্ষুরা পলায়ন করে তিব্বত, নেপাল এবং অন্যান্য দেশে চলে গিয়েছিলেন।অন্য ধর্মাবলম্বীর ন্যায় হিন্দুদের থেকে বৌদ্ধদের পৃথক কোন জাতি ছিল না।একই জাতি আবার কি?একই ঘরে ব্রাক্ষণ ধর্মী ও বৌদ্ধ উভয় মতের অনুসারীরা সহাবস্থান করতেছিলেন।একদিকে নিজ ভিক্ষুদের অভাব,অন্যদিকে ব্রাক্ষণ ধর্মীদের দিকে আকর্ষণ ,এমন কি,ব্রাক্ষণ ধর্মীরা বৌদ্ধদের সাথে রক্তের সম্পর্ক গড়ে তুলতে ছিলেন।বৌদ্ধদের মধ্যে জোলা,ধুনিয়া প্রভৃতি কত কত নিরীহ নীচ জাত বলে






পরিচিত জাতিসমূহের প্রতি অন্য ধর্মাবলম্বীদের তরফ থেকে কখনো ভয়-ভীতি,কখনো প্রলোভন প্রদর্শনের মাধ্যমে আকর্ষণ করতে লাগল।এসব কারণে দুএক শতাব্দীর মধ্যেই বৌদ্ধরা অধিকাংশ হয়ে গেল ব্রাক্ষণধর্মী নচেৎ মুসলমান।






















  • বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজে যে কয়েকজন নিঃস্বার্থভাবে সমাজ ও দেশ সেবায় আত্মোৎসর্গ করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রদ্ধেয় জ্যোতিঃপাল মহাথের। তাঁর জন্মস্থান কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানার বরইগাঁও এর কেমতলী গ্রামে।তিনি বরইগাঁও বৌদ্ধ বিহারে স্থায়ীভাবে থাকেন এবং  ঐ বিহারকে কেন্দ্র করেই গড়ে তোলেন ১ টি পালি পরিবেণ,১টি অনাথাশ্রম,ছাত্রাবাস বয়ন-কেন্দ্র,সমাজ কল্যান কেন্দ্র,লাইব্রেরী ও একটি উচ্চ বিদ্যালয়।এসব কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি সমগ্র কুমিল্লার হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন।তিনি বাংলাদেশ কৃষ্টি প্রচার সংঘ ও এ,বি,সি,পি, বাংলাদেশের জাতীয় কেন্দ্রের সভাপতি।শান্তি আন্দোলনে তাঁর অবদানের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক  বৌদ্ধ শান্তি পদকও সনদে ভূষিত হন।এছাড়া তিনি স্বাধীনতা পদকসহ বিশ্ব-নাগরিকতা লাভ করেন।শ্রদ্ধেয় জ্যোতিঃপাল মহাথেরের পাণ্ডিত্য ও বাগ্মিতা খ্যাতি সর্বজন বিদিত।তাঁর রচিত ও অনূদিত গ্রন্থ এবং রচনাবলী সকল মহলে সমাদৃত।তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে পুগ্‌গল পঞ্ঞতি’, ‘কর্মতত্ব’, ‘বোধি-চর্যাবতার’, ‘বিশ্ব-বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সংঘ সম্মেলন ও মালয়েশিয়া ভ্রমণ’, ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামেব্রক্ষবিহারইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

1 comment:

  1. Anonymous1/31/2022

    Coin Casino Review | Honest Reviews | CasinoRewards
    Comprehensive Coin Casino review 인카지노 for 2021. Includes 제왕카지노 casino games, bonuses, payment methods, and available promo codes. Rating: 3 · ‎Review by 카지노 CasinoRewards

    ReplyDelete